সস্তা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন কিনে আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি?

আমরা যদি মোবাইল বা স্মার্টফোন কিনতে কোনো ভালো ব্র্যান্ডের শো-রুমে না গিয়ে, যদি একটা লোকাল শপে যাই তবে বুঝতে পারব, নামে বেনামে কত রকমের ফোন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমনকি দেখা যায় যে, এদের দামও অনেক কম। আর এসব দোকানে গিয়ে দোকানিদের প্ররোচনায় এসে অনেকে কম দামে মোবাইল ফোন কিনেও ফেলেন।

আমাদের ভেতর অনেকেই আছি, যারা দেশি বা নতুন নাম অজানা কোনো ব্র্যান্ড এর একটি এন্ড্রয়েড স্মার্টফোন হয়ত ৬০০০-৯০০০ টাকায় কিনে নিয়ে আসলাম, এক পর্যায়ে দেখা গেল এতে এমন অনেক স্পেসিফিকেশন রয়েছে ; যা কিনা প্রচলিত ব্র্যান্ড এর স্মার্টফোনগুলিতে একটু বেশি দামে পাওয়া যায়। তখন আমরা যারা এসব মোবাইল ফোন কিনেছি, নিজেকে চালাক ভাবতে শুরু করি। যেমন ধরুনঃ আপনি ৬০০০ হাজার টাকা খরচ করে একটি স্মার্টফোন কিনে আনলাম, যাতে কিনা ২ জিবি র‍্যাম , ২ গিগাহার্জ প্রোসেসর।

এটা স্বাভাবিক যে, আমাদের কাছে স্যামসাং এর ফোনের দামের তুলনায় এই স্পেসিফিকেশন খুবই ভালো মনে হবে। আপনি হয়ত কিনেও ফেললেন। তবে প্রশ্ন হল আপনি যে দামটি দিয়ে সেই কমদামি স্মার্টফোনটি কিনলেন ; এটা কি আসলে একটা ভালো ডিল ছিল, না নিছক প্রতারনার মত? তো বন্ধুরা আজ কথা বলব, এইসব কমদামি স্মার্টফোন সম্পর্কে, আজ জানতে পারবেন – এসব স্মার্টফোন বা মোবাইল ফোন কেনা আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত?

চাইনিজ স্মার্টফোন কি কেনা উচিত ?

স্মার্টফোনগুলো কেন কমদামি

দেখতে একই, স্পেসিফিকেশনও একই একটির দাম ৭ হাজার টাকা, অন্যটির দাম ১৮ হাজার টাকা। আসলে কি পরিবর্তন যা এই স্মার্টফোন দুটিকে দামের দিক এত পরিবর্তিত করল? এর পেছনে কারনটা কি? কারনটা লুকিয়ে আছে ফোনটির ম্যানুফেকচারার বা তৈরিকারক এর ভেতরে।

সাধারনত এসব স্মার্টফোন যারা তৈরি করে তাদেরকে ODM(Original Design Manufacturing) বলে। আর এসব ODM এর মূল আখড়া হল গন-চীনে। জরুরী নয় একটি স্মার্টফোন কোম্পানিকে তাদের নিজস্ব কারখানা থাকতে হবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা চীন এর বিভিন্ন কারখানা থেকে তাদের পন্য বানিয়ে আনে।

প্রিমিয়াম স্মার্টফোনগুলোও চীনেই তৈরি হয়ে থাকে, তবে এগুলো যারা করে তাদেরকে OEM (Original Equipment Manufacturing) বলে। OEM এর পরে এদের ভেতর একদল রয়েছে ODM। চীনের অলি-গলিতে এদের সহজে খুজে পাওয়া যায়। এসব ম্যানুফ্যাকচারারদের মূল কাজ হার্ডওয়্যার এর মধ্যে কাট-কপি-পেস্ট করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা এবং সফটওয়্যার-গত কারসাজি করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা,ইত্যাদি।

আর আমরা যে সব কম দামি স্মার্টফোন দেখি এসব গুলো, কিছু কোম্পানি বেশি লাভের আশায় এদের থেকে বানিয়ে নিয়ে থাকে। আমরা নিচে জানব এসব স্মার্টফোনের দাম কিভাবে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।

হার্ডওয়্যার

স্মার্টফোনে ২ জিবি র‍্যাম, ১.৬ গিগাহার্জ প্রোসেসর, দাম ৯-১০ হাজার টাকা, দারুন! তবে , প্রোসেসরটা যেনো কোন ব্র্যান্ডের? র‍্যাম এর ডিডিআর যেনো কত? ইয়ে মানে, গেম খেলা যায়, ক্যামেরা ভালো, অ্যান্ড্রয়েড লেটেস্ট, ডিসপ্লে বড়। দোকানে সচরাচর ক্রেতা ও দোকানির ভেতর এসব স্মার্টফোন কেনা নিয়ে, এই কথপোকথনই হয়। লাভের আশায় অনেকে কিনে ফেলেন। অনেকের কথা বলা বাদই দিলাম, আমিও নিজে লাভের আশায় কম দামে এসব স্মার্টফোন কিনে ধরা খেয়েছি ; আর বস্তুত কারনেই কোম্পানির নাম উল্লেখ করছি না।

যাই হোক, আপনি কম্পিউটারে হার্ডডিস্ক লাগালেন ভালোকথা, তবে ৩ বছর আগের মডেল,খুবই স্লো। গাড়ির ইঞ্জিন নতুন -পুরাতন সিসি একই, তবে পুরাতনটা তেল বেশি খায়, লাভ কি হল? একদিক দিয়ে লাভের মুখ দেখিয়ে অন্যদিক দিয়ে আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। স্যামসাং এর একটি ৫১২ এমবি র‍্যাম এর মোবাইলে আপনি “নিড ফর স্পীড” গেমটি ইনস্টল করলেন, তবে দেখা গেল কি গেমটি চালু হচ্ছে না – ২ জিবি র‍্যাম লাগবে। এখন আপনার পাশে একটি ২ জিবি রাম এর চাইনিজ স্মার্টফোন আছে ; ভালো কথা, ইনস্টল করলেন গেমটি চালুও হল – তবে দেখা গেল সবই হচ্ছে তবে খালি ল্যাগ করে। কারন র‍্যাম ২ জিবি ঠিক আছে তবে ডিডিআর কম, খুবই স্লো।

কি হল? যে লাউ সেই কদু! এভাবে এসব কম দামি স্মার্টফোনে ২-৩ বছর আগের র‍্যাম, চিপ মডিউল লাগিয়ে বাজারে চালিয়ে দেয়া হয়, যেসব হার্ডওয়্যার নতুন প্রজন্মের স্মার্টফোন এর জন্য উপযুক্ত নয় তা দেয়া হয়। কারন আগে বাজারে যেগুলো প্রচলিত ছিল সেগুলো আগে দাম বেশি ছিল ঠিকই তবে এখন তার দাম কমে গিয়েছে। এভাবে কোম্পানি কমদামি জিনিস লাগিয়ে স্পেসিফিকেশন বাড়িয়ে লাভ করছে । আপনি বাজারে গেলে দেখবেন ৫ম প্রজন্মের কোর আই৫ এর দাম মাত্র ৪-৫ হাজার টাকা, সেখানে অষ্টম প্রজন্মের  কোর আই৫ এর দাম ১৫ হাজার টাকা ; স্মার্টফোন এর ক্ষেত্রেও পার্থক্যটা এখানেই ।

আরও সহজভাবে বলতে গেলে,আজকে বাজারে ৩ জিবি র‍্যাম ফোন আছে- ৩/৪ বছর পর কি এই ৩ জিবি র‍্যাম এর ফোন তৈরি হবে না? হবে। সেই ভবিষ্যতের ফোনে যদি আজকের তৈরি ৩ র‍্যাম এর চিপটি লাগিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কেমন হল? উদাহরন হিসেবে, ইন্টেল সেলেরন প্রোসেসরেরও ২.৪ গিগাহার্জ ভেরিয়েন্ট হয়,আবার ইন্টেল পেন্টিয়াম  প্রোসেসরেরও ২.৪ গিগাহার্জ ভেরিয়েন্ট হয় ; আপনি কোনটা নিবেন?

প্রোসেসর কথা বলতে গেলে এসব ফোনে মিডিয়াটেক,স্পেডট্রাম এসব ছাড়া আপনি আর কোনো প্রোসেসর দেখবেন না। যদিও মিডিয়াটেক এর কিছু প্রোসেসর ভালো, তবুও লো এন্ড প্রোসেসরই বেশি। আউট ডেটেড হার্ডওয়্যার ও এইসব প্রোসেসর এর সংমিশ্রনে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন দারুন স্পেসিফিকেশন, তবে তা কেবল নামমাত্র! প্রোসেসর এর কোর বেশি গিগাহার্জ বেশি কোর, ভালো ; তবে সেই প্রোসেসর যদি লেটেস্ট সফটওয়্যার, ওপারেটিং সিস্টেম এর সাথে অপটাইজই হতে না পারে, তবে লাভ কি হল? ব্যাটারি অতিরিক্ত ইউজ এর কথা নাইবা বলা হল।

এসব স্মার্টফোনের প্রোসেসর কত জেনারেশন বা কত ন্যানোমিটার প্রযুক্তি, সেটা আমার মনে চায়নায় যারা বানিয়েছে তারা ছাড়া, স্বয়ং কোম্পানিও জানে না। আপনাকে শুধু বলা হচ্ছে এত গিগাহার্জ, এত কোর ব্যাস!! দেখা যায় যে, কমদামি মিডিয়াটেক এর অনেক প্রোসেসর এর বেঞ্চমার্ক স্কোর হাই এন্ড বা দামি কুয়ালকমের প্রোসেসরের বেঞ্চমার্ক স্কোর এর সাথেও মিলে যায় – তবে পরে দেখা যায় যে, কুয়ালকমের চেয়ে মিডিয়াটেক ৩৫% বেশি ব্যাটারি খরচ করছে ।

ডিসপ্লে এরকথা বলতে গেলে এসব বেশির ভাগ স্মার্টফোনে আপনি ১০৮০পি এর বেশি রেজুলেশন এর ডিসপ্লে দেখতেই পাবেন না। ১০ হাজার টাকার নিচের ফোনে তো রেজুলেশন তার চাইতেও কম থাকে। ক্যামেরা এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকসময় একি।

ফ্র্যাগমেন্টেশন

এটা অন্যতম একটা বড় সমস্যা। ফ্র্যাগমেন্টেশন নিয়ে ইতিমধ্যে আমার একটা আর্টিকেল রয়েছে। এই সমস্যার ফলে কেনার সময় যে সফটওয়্যার/রম ও অপারেটিং সিস্টেম যা পেয়েছিলেন, ওই ফোন যতদিন টিকে আছে ওই একটাই থাকে; আর আপডেট আসেনা।

সফটওয়্যার, অপারেটিং সিস্টেম জনিত কোন সাপোর্টও আর পাওয়া যায় না, যা আছে তাই। এর কারনে কিনলেন অ্যান্ড্রয়েড ৭, ২ বছর পর অ্যান্ড্রয়েড ১০ আসার পরও আপনি সেই ৭ এই আছেন, আপগ্রেডেশন এর কোনো উপায় খুজে পাচ্ছেন না। হাজার হলেও সস্তা ফোন – কতকিছুই আর দিবে।

পরিশেষে

এইভাবে কোম্পানিগুলো নানা ভাবে সস্তার ভেতর ফেলে আপনার টাকা পয়সা বস্তায় ভরে, আপনাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে। আপনি একটা নামমাত্র স্পেসিফিকেশন পেলেও, বস্তুত আরো নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। বিপরীতদিকে ইতিবাচক ভাবে কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা কম দামেও ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং উপরে উল্লেখিত সীমাবদ্ধতা গুলো থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে স্যামসাং অ্যাপেল এর মত কোম্পানি তাদের কোয়ালিটি বজায় রেখে অসাম সব গ্যাজেটস উপহার দিয়েই যাচ্ছে।

স্মার্টফোনের মত গ্যাজেটস বেশির ভাগ মানুষ দীর্ঘদিন ব্যবহারের জন্য কিনে থাকেন। তাই এটি কিনার আগে সব দিক চিন্তা ভাবনা করে কিনলে একটা ভালো জিনিস পাবেন, যা আপনার দীর্ঘ একটা সময়ব্যাপী সাথী হয়ে থাকবে।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories