লিনাক্সের শুরু : চলুন জানা যাক

উইন্ডোজ ডেক্সটপ কিংবা ম্যাক বা যেকোনো ডেক্সটপ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে কিন্তু লিনাক্সের নাম শোনেনি এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সহজ কথায় বলতে গেলে লিনাক্স হচ্ছে আপনার উইন্ডোজ ডেক্সটপের জন্য একটি অলটারনেটিভ অপারেটিং সিস্টেম, যার কোন একটি ডেক্সটপ এনভার্নমেন্ট আপনি উইন্ডোজের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন, আবার চাইলে লিনাক্স সার্ভার ব্যবহার করে সার্ভার অ্যাপ্লিকেশনসও রান করতে পারেন।

যদিও লিনাক্স মূলত একটি কার্নেল, তবে সাধারনত লিনাক্স বলতে আমরা অনেকগুলো অপারেটিং সিস্টেমের একটি গ্রুপকে বুঝে থাকি, যে অপারেটিং সিস্টেমগুলো লিনাক্স কার্নেল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। তবে টেকনিক্যালি লিনাক্স বলতে মূলত লিনাক্স কার্নেলটিকেই বোঝায়, কোন অপারেটিং সিস্টেম বা কোন স্পেসিফিক ডিস্ট্রো নয়।

শুধুমাত্র লিনাক্স সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের এই পোস্টগুলো একবার পড়ে নিতে পারেনঃ

  • লিনাক্স কি? | উইন্ডোজের বেস্ট বিকল্প, যেটা হাজারো গীক মিলে বানিয়েছেন!
  • লিনাক্স কার্নেল কি এবং এর কাজ কি? [সাধারণ মানুষের ভাষায় ব্যাখ্যা!]
  • কেন আমি লিনাক্সে মুভ করেছি? আর হয়তো কখনোই উইন্ডোজে ফেরত যাবো না!

লিনাক্সের সবথেকে বেশি ব্যবহার দেখা যায় সার্ভারে। আপনি ইন্টারনেটে যত ওয়েবসাইট ভিজিট করে থাকেন, আপনি প্রায় নিশ্চিত থাকতে পারেন যে এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ওয়েবসাইটই লিনাক্স রান করা একটি ওয়েব সার্ভার থেকে সার্ভ করা হয়েছে। বর্তমানে এমন অনেক লিনাক্স সার্ভার আছে, যা বছরের পর বছর ধরে কোন ক্র্যাশ বা হ্যাং করা ছাড়াই একইভাবে রান করছে।

শুধু তাই নয়, লিনাক্স শুধুমাত্র আপনার ডেক্সটপে কিংবা আপনার ওয়েব সার্ভারেই রান করেনা। অধিকাংশ স্মার্ট ডিভাইসগুলোও তাদের অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে আন্ডার দ্যা হুড লিনাক্স কার্নেল ব্যবহার করছে। যেমন- গুগলের তৈরি করা ক্রোমবুক বা ক্রোম ওএস থেকে শুরু করে আপনার স্মার্ট ফ্রিজ বা স্মার্ট ওভেনেও চলছে লিনাক্স।

শুধুমাত্র লিনাক্সের গুনগান গাইতে চাইলে এভাবেই হাজার হাজার ওয়ার্ড লেখা সম্ভব। কিন্তু আপনি এই পোস্টটিতে স্বেচ্ছায় ক্লিক করেছেন, অর্থাৎ ধরেই নেওয়া যায় যে আপনি অলরেডি লিনাক্স সম্পর্কে জানেন। লিনাক্স সম্পর্কে জানলেও অনেকেই লিনাক্স এর ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না।

খুব বেশি গভীরে যাওয়াটাও ভুল হবে, যেহেতু লিনাক্স তৈরির সম্পূর্ণ ইতিহাস বলতে গেলে এই পোস্টটা খুবই টেকনিক্যাল সাইডে চলে যাবে এবং অনেকটা বোরিং হবে। আর আমি নিজেও এত টেকনিক্যাল ডিটেইলস জানিনা। যাইহোক, আজকের পোস্টে খুব সহজভাবে ছোট করে লিনাক্স তৈরির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি। তবে লিনাক্সের ইতিহাস জানার আগে যা জানা প্রয়োজন, তা হচ্ছে,

কম্পিউটারের ইতিহাস

আমরা সবাই জানি, আগেকার দিনে একটা কম্পিউটারের সাইজ ছিল একেকট বাড়ির সমান। এগুলো অপারেট করা কতোটা ঝামেলার কাজ ছিলো, আপনি নিশ্চই ধারণা করতে পারছেন। এছাড়াও প্রত্যেকটা কম্পিউটারের ছিল নিজের নিজের আলাদা অপারেটিং সিস্টেম, যার ফলে এগুলো অপারেট করা আরও বেশি কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। একেকটি স্পেসিফিক কাজের জন্য আলাদা আলাদা সফটওয়্যার তৈরি করা হতো এবং এই সফটওয়্যারগুলো সব কম্পিউটারে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই ছিলো খুবই এক্সপেনসিভ এবং সাধারন মানুষ এগুলো কিনতেও পারতো না এবং বুঝতেও পারতো না।

ইউনিক্স (UNIX) এর ইতিহাস

ওপরে যে সফটওয়্যার সমস্যার কথা বললাম, এই সমস্যাটার একটা সমাধান বের করার জন্যই ১৯৬৯ সালে Bell Labs এর একদল ডেভেলপার UNIX নামের একটি প্রোজেক্ট শুরু করেন যেখানে তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, সব ধরনের কম্পিউটারগুলোর জন্য কমন সফটওয়্যার তৈরি করা যাতে সবগুলো কম্পিউটারেই একই সফটওয়্যার সাপোর্ট করে। খুবই সিম্পল এবং ইফেক্টিভ একটি প্রোজেক্ট ছিলো এটি।

এখানে অ্যাসেম্বলি ল্যাংগুয়েজের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছিলো C ল্যাংগুয়েজ এবং এটির কোডবেস ছিলো রিসাইকেলেবল। যেহেতু এটি রিসাইকেলেবল ছিলো, এই কোডের একটি পার্টকে ব্যবহার করা হয়েছিলো সবগুলো কম্পিউটারের জন্য একটি কমন অপারেটিং সিস্টেম এবং অন্যান্য কমন ফাংশনস তৈরি করতে। কোডবেসের এই যে পার্টটির কথা বলা হয়েছে, এটাকেই মূলত আমরা এখনকার দিনে “কার্নেল” বলে থাকি।  আর, ইউনিক্সের সম্পূর্ণ কোডবেস ছিলো ওপেন-সোর্স।

প্রথমদিকে, ইউনিক্সের ব্যবহার লক্ষ্য করা যেত বড় অর্গানাইজেশনগুলোতে যেমন- সরকার, ইউনিভার্সিটি, ব্যাংক ইত্যাদি জায়গায়। সবগুলো কম্পিউটারে তখনও ইউনিক্স ব্যবহার করা হতো না।

ইউনিক্সের এক্সপ্যানশন

১৯৮০ সালের পরে আইবিএম, এইচপি ইত্যাদির মতো এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি এবং আরও অনেক বড় বড় টেক কোম্পানি নিজেদের ইউনিক্স তৈরি করা শুরু করে। তারা নিজেরা তৈরি করায় তাদের তৈরি ইউনিক্স তারা নিজেদের নামে লাইসেন্স করে এবং এর ফলে ইউনিক্স ব্যবহার করা নিয়ে ইউজারদেরকে লাইসেন্সিং, কপিরাইট এবং আরও অনেক ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়।

এরপর ১৯৮৩ সালে আমেরিকান সফটওয়্যার প্রোগ্রামার রিচার্ড স্টলম্যান একটি GNU ওপেন সোর্স প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করেন, যার লক্ষ্য ছিলো ইউনিক্সের মতোই আরেকটি ফ্রি অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা, যা ব্যবহার করতে ইউজারদেরকে কোন লাইসেন্সিং এবং কপিরাইটের ঝামেলায় পড়তে হবে না। কিন্তু তার প্রোজেক্টটি অবশেষে আর জনপ্রিয়তা পায়নি। এরপরে আরও অনেক ইউনিক্সের মতো ফ্রি অপারেটিং সিস্টেম এসেছে, কিন্তু কোনোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি।

লিনাক্সের শুরু

এমন অবস্থায় আরও কয়েক বছর পরে ১৯৯১ সালে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি শহরে বসবাসকারী ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট, লাইনাস টরভাল্ডস (Linus Torvalds) এর হাত ধরেই মূলত শুরু হয় লিনাক্সের যাত্রা। এখনও পর্যন্ত তিনিই লিনাক্সের জনক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। এবার তিনি নিজেই ইউনিক্সের মতোই একটি ফ্রি অপারেটিং সিস্টেম তৈরির জন্য কোড লেখা শুরু করেন। অতঃপর লাইনাসের এই প্রোজেক্টটিই হয়ে যায় চিরপরিচিত লিনাক্স কার্নেল।

তবে লাইনাস মূলত এই অপারেটিং সিস্টেমটি তৈরি করছিলেন তার নিজের কম্পিউটারে পার্সোনাল ইউজের জন্য। তিনি প্রথমে তার ইন্টেল সিপিইউতে ইউনিক্স ৩৮৬ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি তা অ্যাফোর্ড করতে পারেন নি। সেই সময় যে প্রোজেক্টটি তিনি শুধুমাত্র নিজের মজার জন্য তৈরি করেছিলেন, সেটাই পরবর্তীতে পৃথিবীর সবথেকে বড় এবং সবথেকে জনপ্রিয় ওপেন-সোর্স প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি লিনাক্স কার্নেলকে নিজের পার্সোনাল লাইসেন্সের সাথে রিলিজ করেন এবং প্রথম পর্যায়ে এটি শুধুমাত্র কমার্শিয়াল ইউজেই সীমাবদ্ধ ছিলো। লিনাক্স এর অধিকাংশ টুলসই GNU Software এর এবং এগুলো GNU Copyright এর অধীনে লাইসেন্স করা হয়েছিলো। এরপরে ১৯৯২ সালে, লাইনাস কার্নেলটিকে GNU General Public License এর অধীনে রেজিস্টার করেন যার ফলে বর্তমানে যেকোনো ইউজার সম্পূর্ণ বিনামুল্যে লিনাক্স ব্যবহার করতে পারেন এবং চাইলে লিনাক্সকে নিজের মনমতো কাস্টোমাইজ করে নিতে পারেন।

ফান ফ্যাক্ট- লাইনাস টরভাল্ডস যখন প্রথম লিনাক্স তৈরি করেন, তখন তিনি এটির নাম লিনাক্স রাখার কথা ভাবেন নি। প্রথমত তিনি এই প্রোজেক্টটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ফ্রিয়্যাক্স (Freax)। কারন, নিজের নামের সাথে মিলিয়ে লিনাক্স নাম রাখা তার কাছে খুবই ইগোয়িস্টিক একটি ডিসিশন মনে হয়েছিলো। কিন্তু হাস্যকর হচ্ছে, লিনাক্স প্রোজেক্টের এফটিপি সার্ভারের অ্যাডমিন এই নামটি পছন্দ করেন নি এবং তিনি লাইনাসের পারমিশন ছাড়াই প্রোজেক্টটির নাম চেঞ্জ করে Linux রেখে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে লিনাক্স নামের প্রোজেক্টটি এগিয়ে যেতে থাকে।

আজকের লিনাক্স

লিনাক্স এর সফলতার সবথেকে বড় কারণ হচ্ছে, এক্সিস্টিং ডেভেলপারদের সাপোর্ট। লাইনাস লিনাক্স প্রোজেক্টটিকে ফ্রি এবং ওপেন-সোর্স করার পরে তিনি তার পরিচিত সব ডেভেলপার এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন লিনাক্স প্রোজেক্টে কন্ট্রিবিউট করার জন্য। হাজার হাজার হার্ড-কোর ডেভেলপাররা এবং ইঞ্জিনিয়াররা লিনাক্সকে পছন্দ করেছেন এবং ভালোবেসেছেন। অসংখ্য ডেভেলপার বিনা স্বার্থে লিনাক্স কার্নেলে কন্ট্রিবিউট করেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের লিনাক্স ডিস্ট্রো বা ফ্লেভার তৈরি করেছেন। শুধু তাই নয়, কোর লিনাক্সে এখন যত ফিচারস রয়েছে, এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কন্ট্রিবিউটরদের কারনেই সম্ভব হয়েছে।

ইউনিক্সের সময়কালে ইউনিভার্সাল অপারেটিং সিস্টেম তৈরি যত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো, এর মধ্যে সবথেকে সহজ ইমপ্লিমেন্টেশন এবং সবথেকে ইফেক্টিভ সল্যুশনটাই ছিলো লাইনাসের তৈরি এই প্রোজেক্টটি। লিনাক্সের যে ব্যাপারটা এখনো লাখ লাখ ডেভেলপারদেরকে লিনাক্সে কন্ট্রিবিউট করতে বাধ্য করে, তা হচ্ছে, লিনাক্সের আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড কাস্টোমাইজেবলিটি। এইজন্যই বর্তমানে আমরা ডেক্সটপ কম্পিউটার এবং সার্ভার কম্পিউটাড় ছাড়াও  হাতঘড়ি থেক শুরু করে স্মার্ট ফ্রিজার বা ওয়াশিং ম্যাশিন পর্যন্ত প্রায় সব স্মার্ট ডিভাইসেই লিনাক্সের ব্যবহার লক্ষ্য করতে পারছি।

Images: Shutterstock.com

About the author

সিয়াম

Add comment

Categories