ল্যাপটপ এবং কম্পিউটার আমাদের নিত্যদিনের কাজের সঙ্গী। আর আমাদের এই নিত্য দিনের অতি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসকে সর্বদা শক্তিসালী এবং কার্যশীল রাখছে এর ভেতরককার লজিক বোর্ড তথা মাদারবোর্ড এর মাঝে থাকা এক বিশেষ কম্পোনেন্ট যার নাম হল এর প্রোসেসর যাকে বলা যায় ডিভাইসটির মেইন প্রোসেসিং চিপ। বিশ্বব্যাপী বহু কম্পিউটার এবং ল্যাপটপ এর ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তাদের স্পেসিফিকেশন এর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারব ৯০% ক্ষেত্রে তাদের প্রোসেসরটি তৈরি করেছে ইন্টেল।
আমাদের ভেতর যারা কম্পিউটার এবং ল্যাপটপ ব্যবহার করি ৯৫% ক্ষেত্রে আমাদের সকলের কম্পিউটারে যে প্রোসেসরটি রয়েছে তা ইন্টেলের তৈরি। অ্যাপেল ম্যাকবুক এবং ম্যাক পিসির ক্ষেত্রেও সেখানে আমরা দেখি ইন্টেল এর প্রোসেসর ব্যাবহার করি। তো আজকে আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যে, কম্পিউটার এর ক্ষেত্রে এই প্রোসেসর জায়ান্ট ইন্টেল ; এখানে যাদের সর্বত্র ছড়াছড়ি। সেই কোম্পানি কেন স্মার্টফোন তথা সমমানের মোবাইল ট্যাবলেট ডিভাইস গুলির জন্য ব্যাপকভাবে এসব ডিভাইসের প্রোসেসর বা চিপসেট তথা সিপিইউ তৈরি করছে না? আজকের আর্টিকেলে আমি সে বিষয়ে আলোচনা করব।
স্মার্টফোন বা মোবাইল ডিভাইসে সাধারনত যেসকল প্রোসেসর ব্যবহার করা হয় তাকে বলা যায় একেকটি আইসি বা চিপ। আর এসব আইসি তথা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটকে সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস ফ্যাব্রিকেশন পদ্ধতিতে তৈরি বা প্রস্তুত করা হয়। আর এখানে যা হয় তা হল ফটো-লিথোগ্রাফি বা লাইট/ইউভি-লিথেগ্রাফি প্রক্রিয়ায় একটি সেমিকন্ডাক্টর ওয়েফার এর ওপর চিপ এর জ্যামিতিক প্যাটার্ন অংকন করা হয়। তাছাড়াও ফটো-লিথোগ্রাফি ব্যাতিত সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন এর সময় নানারকম কেমিকেল স্টেপও সম্পন্ন করা হয় ;যার মধ্য দিয়ে সিলিকন এর ব্যবহারে তৈরি হয় একটি পূর্নাঙ্গ প্রোসেসিং চিপ, যাকে স্মার্টফোন তথা সমমানের মোবাইল ট্যাবলেট ডিভাইস গুলির প্রসেসর বা চিপসেট বলা যায়।
কম্পিউটার এর ক্ষেত্রে তো আমরা দেখেছি সেখানে ইন্টেলের একক আধিপত্য; তবে স্মার্টফোন মোবাইল- সমমানের বাজারে এই অবস্থানটি কার? নিঃসন্দেহে এইসময় মুখে যার নাম আসবে তা হল কোয়ালকম। কোয়ালকম তাদের স্ন্যাপড্রাগন সিরিজের নানান মোবাইল চিপসেট/সিপিইউ এর ডিজাইন পেটেন্ট লাইসেন্স করে এই বাজারে ব্যাপক ব্যবসা করে যাচ্ছে। এখানে মিডিয়াটেক বা এএমডি এর কথা বলব না ; এই দুটি কোম্পানির মাধ্যমে আমরা আজ পুরো টপিকটি বোঝার চেষ্টা করব।
কোয়ালকম ইনকর্পোরেট
কোয়ালকম আমেরিকা ভিত্তিক একটি মাল্টিন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর এবং টেলিকমিউনিকেশন সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, যেটিকে সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইরিন এম জ্যাকোব। জ্যাকোব ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৯০ সালে কোয়ালকম সিডিএমএ ভিত্তিক সেলুলার বেজ স্টেশন তৈরির মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। বর্তমানে কোয়ালকম ৪জি এলটিই প্রযুক্তি ভিত্তিক সেলুলার ইকুইপমেন্ট তৈরি করছে।
তবে কোয়ালকম এর মূল রেভেনিউ আসে তাদের মোবাইল ডিভাইস এর জন্য তৈরি চিপ থেকে ; কোয়ালকম মোবাইল ডিভাইস এর জন্য নিত্য অত্যাধুনিক চিপস ডিজাইন করে এবং তার পেটেন্ট লাইসেন্স করে তা বাজারজাত করে বাৎসরিক বড় অংকের টাকা আয় করে থাকে। কোয়ালকম সিডিএমএ টেকনোলজিস,কোয়ালকম টেকনোলজি লাইসেন্সিং ডিভিশন,কোয়ালকম টেকনোলজিস ইত্যাদি সাবসিডিয়ারি ডিভিশন নিয়ে গঠিত কোয়ালকম ইনকরর্পেশন এর মূল সদর দপ্তর স্যান ডিয়েগো ক্যালোফোর্নিয়ায় অবস্থিত।
ইন্টেল কর্পোরেশন
একইভাবে ইন্টেলও আমেরিকা ভিত্তিক একটি মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন ও টেকনোলজি কোম্পানি। স্যামসাং এর পর আয়ের দিক দিয়ে ইন্টেল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেকন্ডাক্টর চিপ তৈরিকারক কোম্পানি। ইন্টেল x86 ভিত্তিক মাইক্রোপ্রোসেসর এর উদ্ভাবক। ইন্টেল মাদারবোর্ড চিপসেট,নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস কন্ট্রোলার, ইন্টিগ্রেডেট সার্কিট,ফ্ল্যাশ মেমোরি,গ্রাফিক্স চিপ এক্সটারনাল প্রোসেসর ইত্যাদি তৈরি করে। ইন্টেলের x86 ভিত্তিক প্রোসেসর সাধারনত পার্সোনাল কম্পিউটার ডিভাইসে বেশি দেখা যায়। ইন্টেল বড় বড় কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যেমনঃ অ্যাপেল,এইচপি (হিউলেট প্যাক্যার্ড),ডেল, লিনোভো এর মত কোম্পানিকে কম্পিউটার প্রোসেসর সাপ্লাই দিয়ে থাকে।
আজকের আর্টিকেলে আরেকটা জিনিস জানব তা হল, মূলত কেন ইন্টেল স্মার্টফোন/ মোবাইল ডিভাইসের জন্য প্রোসেসর তৈরি না করে কেবল কেন কম্পিউটার এর বাজারেই রাজত্ব করে যাচ্ছে। এজন্য প্রথমে আমি তুলে ধরছি ইন্টেল এর সারা পৃথিবীব্যাপি তাদের প্রোসেসর তৈরির কৌশল। আমরা নিশ্চয়ই জানি এখন সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ঘরে কম্পিউটার, ল্যাপটপ এর মত সমমানের ডিভাইস রয়েছে, তারপর বড় বড় ডাটাসেন্টার এর বিশাল বিশাল সার্ভারে কেবল এই ইন্টেল এর অনেক শক্তিশালী প্রসেসর ব্যাবহার করা হয় ; আর এসব এর জন্যে দরকার কোটি কোটি মিলিয়ন মিলিয়ন প্রোসেসর। আর যেখানে সারা পৃথিবীর প্রথম চাহিদা ইন্টেল ; সেখানে ইন্টেলের একান্ত কর্তব্য সর্বপ্রথম এই বিশাল চাহিদাকে পূরন করা।
এসময় আমি উদাহরন হিসেবে বলতে পারি আমেরিকান বিখ্যাত ফাস্টফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস এর কথা। আপনি আমেরিকায় ম্যাকডোনাল্ডস এর কোনো এক আউট লেটে যে বার্গারটি পাবেন, ঠিক একই জিনিস আপনি ভারতের কোনো ম্যাক ডোনাল্ডস এর আউটলেটেও পাবেন। সারা পৃথিবীব্যাপি তাদের মেনু প্রায় একই ; রেসিপি একই কেবল শত শত আউটলেটে তা একই প্রক্রিয়ায় তৈরি করে এই সারা পৃথিবীর ম্যাক ডোনাল্ডস বার্গার এর চাহিদা পূরন করা হচ্ছে।
ইন্টেলও সারা পৃথিবীর এই মিলিয়ন কম্পিউটার প্রোসেসর এর চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্বব্যাপি তাদের অনেকগুলো প্রোসেসর প্লান্ট স্থাপন করেছে। এখানে আমেরিকায় অবস্থিত ইন্টেলের কোনে প্লান্টে যা যা আছে, চায়নায় অবস্থিত ইন্টেলের কোনো প্লান্টেও ঠিক একই একই জিনিস রয়েছে। তারা একইভাবে সারা পৃথিবীতে আরও অর্ধশত প্লান্টে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় একই নিয়ম মেনে কম্পিউটার প্রোসেসর তৈরি করছে। আর এমন সময় তাদের নির্দিষ্ঠ কতগুলো প্রোসেসর মডেল থেকে বের হয়ে হঠাত করে নতুন কোনো ডিজাইনের মডেলে যাওয়া এবং তার প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাত করা ততটা সহজ নয়।
আর তারা যে প্রক্রিয়ায় এক্সটারনাল এবং কিছু কিছু ইন্টারনাল কম্পিউটার প্রোসেসর তৈরি করছে; তা প্রচলিত স্মার্টফোন চিপসেট এর থেকে একদম ভিন্ন। যেহেতু ইন্টেল এখানে নিজেই তাদের প্রোসেসর ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকচার করে তাই তাদের কথা আলদা। বিপরীত দিকে কোয়ালকম তাদের স্ন্যাপড্রাগন প্রোসেসর তথা চিপ ডিজাইন করে ঠিকই তবে তা তৈরি করে আলাদা কোনো সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন কোম্পানির দ্বারা।
কোয়ালকম তাদের ডিজাইন করা প্রতিটি চিপসেট টিসিএমসি তথা টাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির থেকে তৈরি করে নেয়। একইভাবে এনভিডিয়া এবং অ্যাপেল এর মত কোম্পানিও তাদের চিপ টিসিএমসি এর মত কোম্পানি থেকে তৈরি/ফ্যাব্রিকেশন করে নেয়। এসব দেখে যে ইন্টেল চুপ করে বসে থাকবে তা কিন্তু নয়। ইন্টেল মোবাইল ডিভাইস এর জন্য তাদের একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট টাইপের চিপসেট ডিজাইন করেছিল যেটা হল ইন্টেল এটম।
তবে তাদের ইন্টেল এটম মোবাইল ডিভাইস এর এতসব রিসোর্স নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা রাখেনি। যার ফলে ইন্টেল এটম ছিল তাদের মোবাইল ডিভাইস এর জন্য সর্বপরি এসব ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেম যেমনঃ অ্যান্ড্রোয়েড,আইওএস এর জন্য একদম বাজে। সুতরাং ইন্টেল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর জগতে তাদের রাজত্ব যথাযথ ভাবে ধরে রাখলেও মোবাইল সেক্টরে তারা তা করতে পারেনি ; এর অনেকটা মূল কারন এই সেক্টরে তাদের যথেষ্ঠ রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট এর অভাব।
আজ থেকে ১৩ বছর আগে অ্যাপেল তাদের আইফোন এর জন্য ইন্টেলকে প্রোসেসর তৈরি করতে বলেছিল; তবে ইন্টেল তখন বলেছিল ভবিষ্যতে ইন্টারনেট ব্যবহারে মোবাইল ডিভাইস তেমন জনপ্রিয় হবে না ; অথচ তার দশক পর ইন্টেলের সেই স্বীকার্যকে ভুল প্রমানিত করে ইন্টারনেট ব্যবহারে মোবাইল ডিভাইস কম্পিউটার এর চাইতে কয়েকগুণ বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। অবশ্য তাদের এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ইন্টেল যদিও এখন কোয়ালকম কে টেক্কা দেয়ার মত কোনো স্মার্টফোন/মোবাইল চিপ তৈরি করছে না। তবে তারা আসছে ৫জি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মোবাইল ডিভাইস এর জন্য নেটওয়ার্ক মডেম তৈরির কাজ করছে। ভবিষ্যতে আইফোনে কোয়ালকমের মডেম এর বিপরীতে হয়ত ইন্টেলের এসব নতুন ৫জি মডেম দেখা যাবে। পাশাপাশি অন্যসকল স্মার্টফোন তৈরিকারকরাও ইন্টেলের নেটওয়ার্কিং মডেম তাদের স্মার্টফোনে ব্যবহার করবে।
Images: Shutterstock.com