আপনারা সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা আইপি অ্যাড্রেস এর সম্পর্কে নিশ্চয় শুনেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আইপি অ্যাড্রেস কি? এর প্রয়োজনীয়তা কি? এর আলাদা আলদা প্রকারভেদ গুলো কি কি? এই পোস্টে এসকল বিষয় নিয়ে আজ বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি। তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে এইসব মজাদার বিষয় নিয়ে তাড়াতাড়ি আলোচনা শুরু করা যাক।
এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু সমূহ
আইপি (IP) অ্যাড্রেস কি?
বন্ধুরা ভেবে দেখুন তো ইন্টারনেটে আমরা সবাই কি করি? আমরা সবাই ইন্টারনেটে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করি। আপনি হয়তো আপনার ফোন ব্যবহার করে বা আপনার ল্যাপটপ বা পিসি ব্যবহার করে এই ব্লগটি পড়ছেন। কিন্তু এই ব্লগের তথ্য গুলো আসছে কোথা থেকে? এই তথ্য গুলো আসছে কোন এক দেশে অবস্থিত সার্ভার থেকে। এবং আপনি আপনার ফোন দিয়ে সেই সার্ভার থেকে তথ্য গুলো লোড করে স্ক্রীনে দেখতে পাচ্ছেন। অথবা আপনি যখন কোন ইউটিউব ভিডিও দেখেন বা কোন ওয়েবসাইট দেখেন তখন তা বিভিন্ন সার্ভার থেকে তথ্য গুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। আপনার কাছে যখন কোন ইমেইল আসে বা আপনি যখন কোন ইমেইল কোথাও পাঠিয়ে থাকেন তখনও আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের আদান প্রদান করে থাকেন। তো এভাবেই আমরা ইন্টারনেটে যে কার্যকলাপই সম্পূর্ণ করে থাকি না কেন তা আসলে হলো তথ্যের আদান এবং প্রদান।
আগের যুগে যেমন ডাক এবং চিঠির মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন তথ্যকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম, ঠিক আজকের যুগেও একই জিনিষ আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে করে থাকি। এখন মনে করুন আপনার কাছে আমি একটি চিঠি পাঠাতে চাচ্ছি, তবে আমাকে কি করতে হবে? আপনার বাসার অবশ্যই একটি ঠিকানা আছে, এবং তারপর আপনার পাড়ার নাম, আপনার এলাকার নাম, আপনার থানা, আপনার পোস্ট অফিস, আপনার জেলা ইত্যাদি সব ঠিকানা উল্লেখ্য করে আপনাকে ডাক যোগে কোন তথ্য প্রেরন করা সম্ভব। ঠিক একই ভাবে আপনার আমার সবার এক একটি করে বাসার অ্যাড্রেস রয়েছে। আলদা জায়গা এবং আলাদা দেশ ভিত্তিতে অবশ্যই এই অ্যাড্রেস এর ধরণ আলাদা আলদা। কিন্তু যেহেতু ইন্টারনেট পুরো দুনিয়ার মানুষ ব্যবহার করে এবং পুরো দুনিয়ার মানুষ তাদের তথ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গ্রহন এবং প্রেরন করে তাই ইন্টারনেটে তথ্য আদান প্রদান করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ঠিকানা বা অ্যাড্রেস এর প্রয়োজন পড়ে। আর এই নির্দিষ্ট অ্যাড্রেসটিই হলো আইপি অ্যাড্রেস। আইপি অ্যাড্রেস (IP Address) এর পুরো নাম হলো “ইন্টারনেট প্রোটোকল অ্যাড্রেস” (Internet Protocol Address)। প্রোটোকল মানে হলো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অর্থাৎ এটি একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে হবে, এটি সবার কাছে আলাদা আলদা করে থাকবে এবং এটি সবাই ব্যবহার করবেন একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য।
আইপি অ্যাড্রেস এর প্রকারভেদ | আইপিভি৪ (IPv4) ও আইপিভি৬ (IPv6)
একটি সাধারন আইপি অ্যাড্রেসের ভেতর চারটি সেকশন থাকে। এবং এর প্রত্যেকটি সেকশনে জিরো থেকে শুরু করে 255 পর্যন্ত লিমিট থাকে। এটি একটি ৩২ বিট নির্ভর অ্যাড্রেসিং সিস্টেম। এই অ্যাড্রেসের একটি উদাহারন হলো “202.18.32.103”। এটি প্রত্যেকের জন্য একটি করে ইউনিক অ্যাড্রেস থাকে। এবং এই সাধারন অ্যাড্রেসকে বলা হয় আইপিভি৪ (IPv4) অ্যাড্রেস। অর্থাৎ এটি ইন্টারনেট প্রোটোকল অ্যাড্রেসের চতুর্থ নাম্বার সংস্করণ। কিন্তু এই আইপিভি৪ রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর তা হলো এই আইপিভি৪ কেবল মাত্র চার বিলিয়ন ইউনিক আইপি জেনারেট করতে পারে [আইপিভি৪ অ্যাড্রেস লিমিট “৪,২৯৪,৯৬৭,২৯৬]। আপনি যদি চার বিলিয়নের বেশি অ্যাড্রেস তৈরি করতে চান তবে আমার তা প্রথম থেকে জেনারেট হওয়া শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে বিষয় হলো ইউনিক অ্যাড্রেসের, কেনোনা প্রত্যেক জনের কাছে অবশ্যই আলদা আলদা অ্যাড্রেস থাকতে হবে। হয়তো যখন প্রথমবার এই আইপিভি৪ সিস্টেম বানানো হয়েছিলো তখন হয়তো এটা ধারনায় করা হয়নি যে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এতোটা বেড়ে যাবে, বা এক এক ব্যাক্তির কাছে ৩-৪ টা ডিভাইজ থাকবে। তো সম্ভবত তারা ধারণা করতে পারেন নি যে, ঠিক আমাদের কত গুলো আইপি অ্যাড্রেসের প্রয়োজন পড়বে ভবিষ্যতে। আজকের দিনে আইপিভি৪ অ্যাড্রেস লিমিট চার বিলিয়ন যা একদম শেষ হয়ে গিয়েছে। এবং আমাদের কাছে নতুন অ্যাড্রেস একদমই নেই।
আর এজন্যই আমরা এক নতুন সিস্টেম উন্নতিকরণ করেছি, যার নাম হলো আইপিভি৬ (IPv6)। এটি ১২৮ বিট এর একটি অ্যাড্রেসিং সিস্টেম। এর একটি উদাহরণ হলোঃ “3ffe:1900:4545:3:200:f8ff:fe21:67cf”। এবং এই অ্যাড্রেসিং সিস্টেমের সাহায্যে আমরা মোটামুটি অগন্তি আলদা আলদা অ্যাড্রেস জেনারেট করতে পারবো [আমার গোনার ক্ষমতা নাই, তাই অগন্তি 😛 ]। আইপিভি৬ দিয়ে “৩৪০,২৮২,৩৬৬,৯২০,৯৩৮,৪৬৩,৪৬৩,৩৭৪,৬০৭,৪৩১,৭৬৮,২১১,৪৫৬” টি ইউনিক অ্যাড্রেস জেনারেট করা সম্ভব। অর্থাৎ চিন্তা করতে পারছেন, এই সিস্টেমের মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে যদি কয়েক লাখ ডিভাইজও থাকে তবেও ইউনিক অ্যাড্রেস ব্যবহার করে শেষ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আজকের দিনেও আমরা আইপিভি৬ ব্যবহার করি না, আমরা শুধু মাত্র আইপিভি৪ ব্যবহার করে থাকি। কেনোনা আইপিভি৬ ব্যবহার করার জন্য আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার, আপনার মোডেম বা রাউটার এবং ওয়েবসাইট হোস্টিং সার্ভার গুলোকেও একসাথে আইপিভি৬ ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা পড়ে। এবং আমরা আজ পর্যন্ত আইপিভি৬ ব্যবহার করি না।
পুরো দুনিয়াতে ১% এর ও কম আইপিভি৬ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া আমরা সবাই আইপিভি৪ ব্যবহার করে থাকি। আপনার জ্ঞানের জন্য বলে রাখি, আইপিভি৬ যে শুধু একটি আলাদা অ্যাড্রেসিং ফরম্যাট তা কিন্তু নয়। আপনার ডাটার যে প্যাকেট গুলো থাকে এবং আপনার ডাটা গুলো যে ফরম্যাটে থাকে, যে হেডার ফরম্যাট থাকে, প্যাকেটের যে সাইজ থাকে সেগুলোও আইপিভি৪ এর তুলনায় আইপিভি৬ এ বেশি দক্ষ হয়। এবং আপনার ইন্টারনেট পারফর্মেন্স বাড়াতেও আইপিভি৬ সাহায্য করে থাকে। এখন এটা দেখার বিষয় যে ঠিক কবে থেকে আমরা এই অ্যাড্রেসিং সিস্টেম অর্থাৎ আইপিভি৬ ব্যবহার করা শুরু করি।
আইপিভি৪ এর লিমিট যখন শেষ হয়েই গেছে, তো আজকের দিনে নতুন ডিভাইজ গুলোতে কীভাবে এটি ব্যবহার করা হয়?
আমি জানি, আমি যখনই বলেছি যে আইপিভি৪ লিমিট মাত্র চার বিলিয়ন পর্যন্ত এবং আমরা আজ পর্যন্ত সকল আইপিভি৪ অ্যাড্রেস শেষ করে ফেলেছি ঠিক তখন থেকেই হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, তাহলে যারা নতুন মোবাইল কেনে বা নতুন কম্পিউটার কিনছে তারা কীভাবে তাদের জন্য নতুন আইপি অ্যাড্রেস জেনারেট করছে? কেনোনা লিস্ট তো শেষ হয়ে গিয়েছে।
তো এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা একটি টেকনিক তৈরি করেছি যার নাম হলো এনএটি (NAT) অর্থাৎ নেটওয়ার্ক অ্যাড্রেস ট্র্যান্সলেসন (Network Address Translation)। বন্ধুরা, আপনার ঘরের যতো গুলো ডিভাইজ আপনার ল্যাপটপ বা মোবাইল বা টিভি যে রাউটারের সাথে সংযুক্ত আছে তার আইপি অ্যাড্রেস কিছুটা এই রকম, যেমন আপনার মোবাইলের আইপি 192.168.0.20 বা আপনার ল্যাপটপের অ্যাড্রেস 192.168.0.25 অথবা আপনার টিভির অ্যাড্রেস 192.168.1.40। তো এই 192.168 থেকে শুরু করে যতো গুলো অ্যাড্রেস থাকে এগুলো আপনার লোকাল অ্যাড্রেস, যেগুলো আপনার রাউটার বা মোডেম আপনার ডিভাইজ গুলোকে দিয়ে থাকে। কিন্তু যেটি এক্সটারনাল অ্যাড্রেস হয় সেটি কিন্তু একটিই হয়। বিষয়টি সহজ আরো সহজ করে বোঝার জন্য মনে করুন আপনি রাউটারে কানেক্ট থাকা একটি ফোন থেকে কোন ওয়েবসাইট এর জন্য রিকুয়েস্ট করলেন এবং একই রাউটারে থাকা একটি ল্যাপটপ থেকে ইউটিউব ভিডিও রিকুয়েস্ট করলেন, তো সেই রিকুয়েস্ট গুলো কিন্তু ওয়েব সার্ভার গুলোর কাছে একই অ্যাড্রেস থেকেই যাবে এবং আপনার রাউটারটি জানে যে ঠিক কোন ডিভাইজ থেকে এই রিকুয়েস্ট গুলো করা হয়েছিলো এবং সে অনুসারে আপনার রাউটার ওয়েব সার্ভার থেকে প্রাপ্ত ডাটা গুলো সে সে ডিভাইজে প্রদান করে দেয়। তো এই এনএটি সিস্টেম এক আইপি অ্যাড্রেসের পেছনে অনেক গুলো অ্যাড্রেস লুকিয়ে রাখে এবং আমরা সেই চার বিলিয়ন অ্যাড্রেসেই আজ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে আসছি।
আইপি অ্যাড্রেস নিয়ে আরো কিছু বিষয়
আপনার ডিভাইজটির আইপি অ্যাড্রেস কি তা যদি চেক করতে চান তবে সাধারন ভাবে গুগলে প্রবেশ করুন এবং সার্চ বারে গিয়ে টাইপ করুন “What is my IP”। ব্যাস, সার্চ রেজাল্টে আপনি আপনার অ্যাড্রেস দেখতে পেয়ে যাবেন। আবার কিছু লোক আছে যারা তাদের আসল অ্যাড্রেস পরিবর্তন করে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন, এবং চিন্তা করেন যে আর কেউ তাদের ট্রেস করতে পারবে না। আসলে এটি ভুল ধারণা, আপনি যে অ্যাড্রেস পরিবর্তন করেই ইন্টারনেট ব্যবহার করুন না কেন আপনাকে তারপরেও ট্রেস করা সম্ভব। তাই অ্যাড্রেস পরিবর্তন কোন প্রকার অসৎ কাজ করার চিন্তা একদমই ভুলে যান। এবং সেটিই আপনার জন্য ভালো হবে।