সময়টা ছিল ১৯৬৯—ঠিক যে সময় পূর্ব পাকিস্হানে এক আন্দোলনরত পরিস্হিতি বিরাজমান ছিলো। ঠিক বিপরীত দিকে আমেরিকায় সময়টা ছিলো বিপ্লব ও উদ্বাবনের। সেসময় দেশটিতে মাইক্রোচিপ প্রযুক্তিটির প্রসার ঘটতে শুরু করে। এইসময় ততকালীন আমেরিকায় এক তরুন বিপ্লব আন্দোলন চলছিলো, তারা তাদের নানা সুবিধা, ইচ্ছা বাস্তবায়নে একযোগে এক কাউন্টার-কালচার মুভমেন্ট শুরু করেছিল। এর মূল কেন্দ্র ছিলো আমেরিকার স্যান ফ্রান্সিসকো। এই আন্দোলনে তরুনেরা কোন বাধা-ধরা নিয়ম এর তোয়াক্কা না করে তাদের নিজেদের মত জীবন গড়ে তোলার পথ ধরতে শুরু করে। আর এটাই ছিল সুবর্ন সময় তরুনদের দ্বারা পৃথিবীতে বড় কোন রেভুলিউশন আনার।
- স্যামসাং – প্রযুক্তি সৃষ্টিতে সেরা কোম্পানিটি তৈরির গল্প!
- ফ্লাগশীপ কিলার স্মার্টফোন কোম্পানি ওয়ানপ্লাস তৈরির গল্প!
- প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শাওমি তৈরির গল্প!
ঠিক এরকম একটা পরিস্হিতিতে ১৪ বছর বয়সী কলেজ পরিত্যাগকারী স্টিভ জবস এর পরিচয় হয়, ১৯ বছর বয়সী স্টিভ ওয়াজনিয়াক এর সাথে। তারা দুজনেই প্রযুক্তিতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। এখানে থেকে পরিচয়ের পর থেকে তারা দুজনে মিলে নতুন কিছু করতে উদ্দোগী হন। আর তারা হয়ত তখন জানতেন না, তারা তৈরি করতে চলেছেন এমন কিছু যা কিনা সারা পৃথিবীর কম্পিউটিং ও মোবাইল জগতের জন্য এক বিশাল রেভুলিউশন হয়ে থাকবে।
বহু মানুষের প্রানের চেয়ে প্রিয় – পৃথিবীর সবচাইতে সফল স্টার্টআপ অ্যাপলের যাত্রা শুরু হয়েছে আমেরিকার ছোট্ট একটি বাড়ির গ্যারেজে। তিন বন্ধুর খুবই আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। আগে তাদের সাথে ছিলেন রোনাল্ড ওয়েন নামে আরেকজন,যার কাছে ততকালীন সময়ে অ্যাপলের ১০% স্টেক ছিলো, তবে জানুয়ারি৩,১৯৭৭ এ তিনি ৮০০ ডলারে তা বেচে দিয়েছিলেন। সেই শেয়ার যদি তিনি রেখে দিতেন, আজ তার দাম হত ৭৪ বিলিয়ন ডলার।
যাই হোক, স্টিভ, ওয়াজনিয়াক ও রোন্যাল্ড এর হাতে ১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল অ্যাপেল কম্পিউটার কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিল,অ্যাপেল ১ কম্পিউটার উৎপাদন এর মধ্য দিয়ে। পরে ১৯৭৭ এ ওয়েন চলে গেলে, স্টিভ ও ওয়াজনিয়াক মিলে অ্যাপেল ২ বাজারে আনে।
অ্যাপেলের যাত্রা
অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানির প্রথম প্রোজেক্ট ছিলো অ্যাপেল ১ কম্পিউটার,যেটিকে ততকালীন সময়ে ৬৬৬ ডলারে বাইট কম্পিউটার শপের অধীনে বাজারে ছাড়া হয়েছিলো । এইসময় ওয়াজনিয়াক ছিলেন একজন ট্যালেন্টেডড ইলেকট্রনিক্স সেলফ-এডুকেটেড ইঞ্জিনিয়ার। তিনি সে সময় একটি বক্সের মত যন্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যেটি কিনা, দূরবর্তী ফোন কল করতে পারত কোনরকম টাকা বা বিল ছাড়াই,আর সেইসময় তিনি এর বেশ কয়েক মডেলও বিক্রি করেছিলেন। এইসময় স্টিভ জবস, ওয়াজনিয়াককে দিয়ে একটি কম্পিউটার তৈরি করানোর জন্য রাজি করেন। এইসময় তারা একটি ভালো কম্পিউটার তৈরি এবং তা ভালো দামে বিক্রি করার স্বপ্ন দেখেন।
জবস তখন এই বিষয়ে স্হানীয় একটি কম্পিউটার শপ, দ্যা বাইট শপ এর সাথে যোগাযোগ করে। এখানে বাইট শপ তাদের মেশিনের প্রতি আগ্রহ দেখায় এবং জানায় কম্পিউটারটি যদি পুরোপুরি এসেম্বেলড হয় তবে তা তারা কিনবে এবং বিক্রি করবে। তারপর বাইট শপ এর মালিক পল টেরেল ৫০ টি কম্পিউটার এর অর্ডার দেয়, প্রতিটি ৫০০$ ডলার করে। তারপর অর্ডার নিয়ে স্টিভ ক্র্যামার ইলেকট্রনিক্স নামক একটি দোকানে যায় ক্রামার ইলেকট্রনিক্স হল ততকালীন সময়ে সেখানকার সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিক্স কম্পোনেন্ট ডিস্ট্রিবিউটর। স্টিভ ওয়াজনিয়াক সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কম্পোনেন্ট কেনে, যা তাদের কম্পিউটার বানাতে দরকারী ছিলো।
ক্র্যামার ইলেকট্রনিক্স টাকা চাইলে, স্টিভের উত্তরটা ছিলো, আপনি আামাকে ৩০ দিনের টার্মে কম্পোনেন্ট গুলো দিন, এতে করে আমি ৫০ টি কম্পিউটার রেডী করতে পারব এবং তারপর বাইট শপের মালিক পল টেরেল আপনাকে আপনার টাকা দিয়ে দেবে।
তারপর ক্র্যামার ইলেকট্রনিক্স এর ম্যানেজার পল টেরেল কে ফেন দেয় এবং সত্যতা যাছাই করে। পল ফোনে তাদের জানায় যদি কম্পিউটার তৈরি হয়ে তাদের শপে আসে তবে ক্র্যামার ইলেকট্রনিক্স তাদের প্রাপ্য টাকা পেয়ে যাবে। তারপর তারা স্টিভ ও ওয়াজনিয়াক এর হাতে কম্পোনেন্ট হস্তান্তর করে। এরপর দিনরাত এক করে স্টিভ এবং তার ছোট টিম অর্ডারপূরন করতে সক্ষম হয়। তারা এর ফলে একটা বড় এমাউন্ট হাতে পায়। আর এটি ছিল অ্যাপলের সফলতার শুরু এক ছোট পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। এটা ছিলো অ্যাপেল কম্পিউটার ১।
এটা ছিলো ওই সময়কার প্রথম কম্পিউটার যাতে প্রদর্শন এর জন্য ডিসপ্লে হিসেবে একটি সাদাকালো টিভি ছিলো। এরপর অ্যাপেল নতুনভাবে তাদের কাজ শুরু করে। তাদের চাহিদা ক্রমে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে এবং পরবর্তীতে তারা অ্যাপেল ২ তৈরি করে এবং প্রচুর বাজার পায়। অ্যাপেল নিমিষেই ততকালীন কম্পিউটার বাজারের এক নেতৃত্বস্হানীয় পর্যায়ে চলে যায়। এরপর অ্যাপেল বহু মেধাবী, যেমনঃ বিল গেটস এর মত মানুষও যোগ দেয় এবং অ্যাপেলকে অনন্য বানাতে সহযোগিতা করে। পরে অবশ্য বিল গেটস অ্যাপেল ছেড়ে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা করে (আরেকটি আর্টিকেলে তা জানব)।
কোটি মানুষের প্রিয় অ্যাপেল
অনেকে মনে করেন অ্যাপেলের মূল লক্ষ্য আবিস্কার বা ইনভেন্ট করা, তবে আসলে তা নয়। অ্যাপেল সেই প্রোডাক্টই হাতে নেয় যা তারা ভালো বানাতে পারবে। নতুন আবিস্কার করেই হোক বা অন্যকিছু যা ইতিমধ্যেই আবিস্কার হয়ে গিয়েছে।১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অ্যাপেল অনেক উপরে উঠেছিল পার্সেনাল কম্পিউটার ম্যাকিনটস এর জোড়ে। মানুষ একে স্বাদরে গ্রহন করে নিয়েছিল। তখনকার সময়কার একমাত্র পাসোর্নাল কম্পিউটার, যাকে চালানোর জন্য প্রোগ্রামিং করা লাগতো না।
যাই হোক,বাস্তবিকভাবে অ্যাপেল ম্যাকিনটস এর পর কোন প্রোডাক্ট বা প্রোডাক্ট ক্যাটাগরি ইনভেন্ট করেনি। তারা এমন কিছুই করেছে যার কনসেপ্ট অনেক আগে থেকেই ছিলো। তবে একটা জিনিস শিউর যে তারা পৃথিবীর প্রথম কমার্শিয়াল পার্সোনাল কম্পিউটার অ্যাপেল ২ ইনভেন্ট করেছিলো, এটি ছিলো তাদের প্রথম তৈরি কম্পিউটার অ্যাপেল ১ এর সাক্সেসর। অ্যাপেলে ম্যাকের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম সুন্দর গ্রাফিকাল ইন্টারফেস সহ ইউজার ইন্টারফেস ও মাউসের ব্যবহার পৃথিবীকে তাক লাগাতে বাধ্য করেছিল। তবে তার ওর থেকে অ্যাপেলের অন্যান্য প্রোডাক্টগুলো ছিলো রিইনভেন্টেড। যেমনঃ অ্যাপেল কিন্তু এমপি৩ প্লেয়ার আবিস্কার করেনি, তারা তাকে রিডিজাইন করে আরও সুন্দর ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে। অ্যাপেল কিন্তু স্মার্টফোন আবিস্কার করেনি, তারা তাকে নিজেদের মত করে পূনরায় ডিজাইন করে আরও ভালো বানিয়েছে। অ্যাপেল ট্যাবলেট পিসি আবিষ্কার করেনি, তারা একে পূর্ণ-উদ্ভাবন করেছে এবং আরও ভালো করে তৈরি করেছে।
আর এবিষয়ে অ্যাপেলের একজন চিফ ডিজাইন বলেন, অ্যাপেলের লক্ষ্য খুবই সাধারন – সেটা হল ভালো করে ডিজাইন করে একটি বেটার প্রোডাক্ট উপস্হাপন করা। অ্যাপেল যদি কোন প্রোডাক্ট ভালো করে বানাতে সক্ষম নয় বলে মনে করে তবে তারা তা বানায় না। অ্যাপল তাদের এই নীতি প্রথমে অ্যাপ্লাই করে আইপডের ওপর, তারপর স্মার্টফোনের ওপর আর এখন পর্যায়ক্রমে তারা তা একের পর এক করছেই।
মানুষের অ্যাপেল পছন্দ করার পেছনে অন্যতম একটি কারন অ্যাপেল তাদের প্রোডাক্টে অনন্য কিছু ফিচার ব্যবহার করে, যা মানুষ কার্যকর ভাবে অন্য কোথাও পায় না। উদাহরন হিসেবে আইফোনের অ্যাক্টিভেশন লক এর কথাই বলা যেতে পারে। এটি আইফোনের চুরির প্রতিরোধে অন্যতম একটি ভূমিকা পালন করছে। চুরি করার পরও চোর আইফোন এর ভেতর এক্সেস করতে পারে না, অনেক সময় ফোনটিকে খুজে পেতেও মালিকের একারনে অনেক সুবিধা হয়। অন্যান্য অনেক কোম্পানি এই ফিচারটি তাদের মত করে উদ্ভাবন করলেও অাইফোনের মত কার্যকর করে তুলতে পারেনি। এইভাবে অ্যাপেলের প্রতিটি প্রোডাক্ট মানুষের নানাভাবে নানাকারনে পছন্দ।
যদিও বা আমাদের সবার অ্যাপেল ব্যবহারের সামর্থ্য নেই, তবে এটা মানতে হবে অ্যাপেল ছিলো বিশ্ব ইতিহাসে সবচাইতে বড় প্রযুক্তি সার্টআপ। তারা তাদের শুরু দিকে আইবিএম ও মাইক্রোসফট এর সাথে প্রতিযোগিতা করেছে। আজ তারা নিজেদের আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছে। এমন একটি অবস্থান তৈরি করেছে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করা কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কেননা অ্যাপেল তাদের নিজস্ব ধাচে অন্যদের থেকে একদম আলাদা, কেউ তা নিতে বা চুরি করতে পারবে না, যেমনঃ আইওএস,ম্যাক ইত্যাদি। মানুষ যেভাবে অ্যাপেলকে ভালোবেসেছে, সেভাবে তারা অনবদ্য গ্যাজেটস বানাতে থাকলে এভাবেই চিরদিন বেচে থাকবে স্টিভ জবসের ভালোবাসায় তৈরি অ্যাপেল।
Images: Shutterstock.com