নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন কিভাবে কাজ করে?

যখন মানুষ ট্রেনে বা বাসে থাকে তখন কেন এতো উচ্চ ভলিউমে গান শোনার প্রয়োজন পড়ে? কিংবা আপনি যখন বাজারে থাকেন, তখন কেন কোন ফোন আসলে উচ্চ স্বরে কথা বলেন? কেনোনা বাসে বা ট্রেনে চারপাশে অনেক কোলাহল থাকে, কিন্তু আমরা পছন্দের মিউজিকের অসাধারন বিট গুলো মিস করতে চাই না, তাই গানের ভলিউম বাড়িয়ে শুনতে হয়। আবার বাজারেও অনেক কোলাহল থাকে, ফলে উচ্চ স্বরে কথা না বললে আপনার আওয়াজ বাজারের কলাহলে হারিয়ে যাবে। তবে চিন্তার কোন কারন নেই, এই সমস্যা সমাধানের জন্যই রয়েছে নয়েজ ক্যানসেলিং প্রযুক্তি। এই অসাধারন প্রযুক্তি যেকোনো পেছনের কোলাহলকে আটকিয়ে, আপনাকে কোন প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিরক্তি না দিয়েই মিউজিক শুনতে সাহায্য করে। আর যদি মিউজিক আর কোলাহলের মধ্যে কোন যুদ্ধই না থাকে—তবে এবার নিশ্চিন্তে মিউজিক প্লেয়ারের ভলিউম কমিয়ে নিতে পারেন। চলুন এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে তা বিস্তারিত করে জেনে নেওয়া যাক।

নয়েজ ক্যানসেলিং

আপনার হেডফোনে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ হ্রাস করার জন্য দুই প্রকারের প্রযুক্তি রয়েছে। একটি প্রযুক্তি হলো প্যাসিভ নয়েজ রিডাকশন বা নয়েজ আইসলেশন—এটি সাধারন এবং সহজ একটি উপায়, এবং আরেকটি অ্যাকটিভ নয়েজ রিডাকশন—এটি একটি অ্যাডভান্স প্রযুক্তি। প্যাসিভ নয়েজ রিডাকশন টেকনিকে হেডফোন গুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে সেগুলো কানের সাথে খুব সুন্দর করে ফিট হয়ে যায়। কানের সাথে একদম উপযুক্ত ফিট হওয়ার জন্য বাহিরের কোন আওয়াজ, কারো কণ্ঠসর, কোলাহল কিছুই কানে আসতে পারেনা। এই হেডফোন গুলোর ইয়ারবাডে নরম ফম বা নরম রাবার লাগানো থাকে; যখন এগুলো কানে পরিধান করেন তখন এই ফোমটি আপনার কানের সাথে চেপে যায়, এবং কানের ছিদ্র সম্পূর্ণভাবে সীল করে দেয়।

অ্যাকটিভ নয়েজ রিডাকশন

ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ থেকে সবচাইতে কার্যকরী এবং আধুনিক উপায়ে মুক্তি পাওয়ার টেকনিক হলো অ্যাকটিভ নয়েজ রিডাকশন টেকনিক। এই টেকনিক বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন বানাতে সাহায্য করে এবং এই ধরনের হেডফোন সাধারনত পাইলটরা পরিধান করে থাকেন। এই হেডফোনের সাথে একটি ছোট মাইক্রোফোন লাগানো থাকে। এই মাইক্রোফোনটি লাগাতার ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ রেকর্ড করে এবং হেডফোনের ভেতরে থাকা ইলেক্ট্রনিক সার্কিটে পৌছিয়ে দেয়। এই সার্কিটটি ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজকে উল্টিয়ে প্লে করে এবং আপনার আসল মিউজিকের সাথে মিলিয়ে দেয়। হেডফোনের ভেতরে উৎপন্ন হওয়া উল্টা প্লে হওয়া নয়েজ এবং আপনার কানে আসা আসল নয়েজ মিলে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ ক্যানসেল হয়ে যায়, ফলে আপনি শুধু মিউজিক শুনতে পারেন।

অ্যাকটিভ নয়েজ রিডাকশন কীভাবে কাজ করে?

মনেকরুন আপনার বাড়ির পাশে কোন বিল্ডিং মেরামতের কাজ চলছে, ফলে সেখান থেকে অবিরত বিরক্তিকর ড্রিলিং এর নয়েজ আসছে। এই অবস্থায় আপনি আপনার নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোনটি পড়লেন এবং সেটিকে অন করলেন, আর ড্রিলিং এর নয়েজ ভার্চুয়ালি গায়েব হয়ে গেলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কাজ করলো কীভাবে? আমার আগের আলোচনা অনুসারে আপনি জানেন যে, হেডফোনটি ড্রিলিং এর নয়েজ রেকর্ড করে তা আপনার কানে ইনভার্ট করে আসল নয়েজের সাথে প্লে করে। কিন্তু এতে নয়েজ সম্পূর্ণরূপে গায়েব হয়ে গেলো কীভাবে? এবং একসাথে দুইটি সাউন্ড মিলে উচ্চ সাউন্ড তৈরি না করে কেন সাউন্ড নিস্তব্ধ হয়ে গেল? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

শব্দ এমন একটি শক্তি যা বাতাসের মাধ্যমে তরঙ্গ আকারে ভ্রমন করে। শব্দ তরঙ্গ সমুদ্রের ঢেউ এর মতো নয়—এমনকি আপনি শব্দ তরঙ্গকে দেখতেও পারবেন না। যদি আমরা শব্দের ভ্রমন করা দেখতে পেতাম, এটি বাতাসের অণু গুলোকে কিছু স্থানে সংকুচিত এবং কিছু স্থানে প্রসারিত করে এগিয়ে চলছে (যেমন ভাবে একটি তরঙ্গ বা ঢেউ তৈরি হয়)। এখন মনেকরুন একটি শব্দ তরঙ্গ ড্রিল মেশিন থেকে আপনার কান পর্যন্ত বয়ে আসছে। এবার ধরুন ঠিক একই সময়ে আপনার কানে যদি ড্রিলের শব্দ তরঙ্গের একদম উল্টা ভার্সন শোনানো হয়, তবে দুই ভার্সনের শব্দ মিলে নীরবতার সৃষ্টি হবে।

সম্পূর্ণ বিপরীত একটি তরঙ্গ এর আসল তরঙ্গের সাথে মিলিয়ে দেওয়াকে অ্যাটিফেজ বলা হয়। এতে নতুন কোন শব্দ সৃষ্টি না হয়ে নীরবতার সৃষ্টি হয়।

বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন পরীক্ষা করা যাক

একটি আসল শব্দ তরঙ্গ এবং ঠিক তার বিপরীত শব্দ তরঙ্গ মিলে নীরবতা সৃষ্টি করে, এটি কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তো চলুন একটি পরিক্ষার মাধ্যমে বিষয়টিকে পরিষ্কার করা যাক। একটি সাধারন সাউন্ড রেকর্ডিং প্রোগ্রাম ওডাসিটি (Audacity) ব্যবহার করে সহজেই এটি পরীক্ষা করা সম্ভব।

১. একটি আসল টোন নেওয়া যাক—

প্রথমে আমি ২ সেকেন্ডের এবং ৪৪০ হার্জের একটি আসল টোন রেকর্ড করলাম;

২. এবার একই আসল টোনটির বিপরীত ভার্সন তৈরি করলাম—

আমি ওডাসিটি প্রোগ্রাম ব্যবহার করে আগের আসল টোনটির একটি ইনভার্ট ভার্সন তৈরি করলাম,

৩. এবার দুইটি শব্দকে একত্র করে প্লে করার পালা

এবার ওডাসিটিতে দুটি অডিও একসাথে করে, একটি আসল এবং একটি উল্টানো, নতুন একটি অডিও তৈরি করলাম,

দেখুন একটি আসল এবং ঠিক তার বিপরীত শব্দ তরঙ্গ মিলে কীভাবে নীরবতা সৃষ্টি করেছে। এভাবে আপনি যেকোনো গান বা মিউজিক এক আসল এবং ইনভার্ট ভার্সন একত্র করে নীরব শব্দ পেয়ে যাবেন। তবে ব্যস্তব নয়েজ ক্যানসেলিং প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ নয়েজ ক্যানসেল করা সম্ভব হয় না, এতে হালকা একটু ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ থেকেই যায়, কিন্তু তারপরেও এটি আপনাকে অনেক ভালো মিউজিক এক্সপেরিয়েন্স দিতে সক্ষম।

শেষ কথা

প্যাসিভ নয়েজ রিডাকশন হেডফোনের তুলনায় অ্যাকটিভ নয়েজ রিডাকশন হেডফোনের দাম একটু বেশি হয়—তবে এটি অনেক ভালো মিউজিক উৎপন্ন করতে সক্ষম। মোবাইলের নয়েজ ক্যানসেলিং মাইক্রোফোনও ঠিক একই পদ্ধতিতে কাজ করে। যাই হোক, আশা করছি আজকের পোস্ট থেকে এই প্রযুক্তির সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন, এবং সরাসরি প্রমান পেয়ে আরো উপভোগ করতে পেড়েছেন। এ সম্পর্কে বা যেকোনো টেক রিলেটেড প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। পোস্ট শেয়ার করতে কখনোই ভুলবেন না।

/Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories