ইন্টারনেট- ওয়ার্ডটি এখনকার দুনিয়ার সবথেকে ইম্পরট্যান্ট ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে কারো কাছে ইন্টারনেট সংযোগ নেই এটা মানুষের চিন্তারও বাইরে থাকে। কারেন্ট সিচুয়েশনটি এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের পাশাপাশি “ইন্টারনেট” জিনিসটিও মানুষের মৌলিক চাহিদার মতো হয়ে গেছে। জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তে আমরা জেনে এবং না জেনেই ইন্টারনেট ব্যাবহার করছি এবং ইন্টারনেটের সাহায্য নিচ্ছি।
তবে আপনি কি চিন্তা করতে পারেন যে আগামীকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি যদি দেখেন যে, পৃথিবীর কোথাও আর ইন্টারনেট কাজ করছে এবং এবং আর কখনোই ইন্টারনেট কাজ করবে না, তাহলে কি হবে? কেমন হবে আপনার লাইফ, আর কেমনই বা হবে পৃথিবীর অন্যান্য সবার লাইফস্টাইল? ইন্টারনেটহীন পৃথিবী কেমন হতে পারে? আপনি কি ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল না করে বেঁচে থাকতে পারবেন? প্রত্যেকদিন ঘুমানোর আগে বন্ধুবান্ধবের সাথে চিকেন ডিনার না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন? আপনি এই লেখাটি পড়তে পারছেন, এর অর্থ হচ্ছে এখনো পর্যন্ত আপনার ইন্টারনেট সচল আছে। কিন্তু কি হবে যদি হটাত কেউ একজন বা কোনকিছু ইন্টারনেটের সুইচটি বন্ধ করে দেয়?
আমি জানি, আপনি সারাদিন তর্ক করতে পারেন এটা নিয়ে যে, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের মন এবং আমাদের সোসাইটির জন্য কতটা হেল্পফুল এবং উপকারি হতে পারে। হ্যা, অবশ্যই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে হার্ডকোর স্মার্টফোন অ্যাডিক্টরাও তাদের ফোন স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে মানুষের সাথে রিয়াল লাইফ কনভারসেশন করবে এবং সেটা অবশ্যই খুবই ভালো একটি ব্যাপার। তাছাড়া ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আবিষ্কার করবো যে, আমরা স্মার্টফোনের সাহায্যে ফোনকলও করতে পারি। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কমিউনিকেশনের পুরনো দিনের মেথডগুলোকে ফেরত আনবো। যেমন ফ্যাক্স ম্যাশিন, টেলিগ্রাম ম্যাশিন, তারযুক্ত টেলিফোন ইত্যাদি। আমরা কোনকিছু নোট করে রাখার জন্য আমাদের ফোনের নোটস অ্যাপটি ওপেন করবো না, বরং ব্যাবহার করবো অ্যাকচুয়াল কাগজ এবং কলম।
ওহ হ্যা, এছাড়া আমাদের এন্টারটেইন করার জন্য তো টেলিভিশন থাকবেই। গত কয়েকবছরে মানুষের টেলিভিশন দেখার হার অনেকটাই কমে গিয়েছে। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে খুব কম মানুষই বিনোদনের লক্ষ্যে টেলিভিশন দেখেন। আর বর্তমানে তো টেলিভিশন যন্ত্রটি বাসার বয়স্ক লোকজনরা ছাড়া আর কেউ অনও করে না, মানে সহজ কথায় যারা স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট খুব বেশি ব্যাবহার করে না, তারাই বিনোদনের জন্য এখনো টেলিভিশন ব্যাবহার করে। আর ইন্টারনেট যদি বন্ধ না হয়ে যায়, তাহলে মানুষের টেলিভিশন দেখার হার আস্তে আস্তে আরও কমতে থাকবে। আর ঠিক সেভাবেই, ইন্টারনেট পারমানেন্টলি বন্ধ হয়ে গেলে আমরা সবাই আবারো টেলিভিশন দেখবো।
তবে ইন্টারনেটের অভাবে পৃথিবী কিন্তু একেবারে থেমে যাবে না। কারন, এখন প্রায় ৪ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের কাছে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নেই। তাই যাদের কাছে এমনিতেই ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নেই, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের কোনই সমস্যা হবে না। তাই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ সেটা নোটিসই করতে পারবে না। তবে সেটা শুধুমাত্র সীমিত সময়ের জন্য। ইন দ্যা ল রান, ইন্টারনেটের অভাব পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকেই কম-বেশি ভোগাবে। তবে আপনি বা আমি নই, আপনি-আমি আমরা ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই লক্ষ্য করতে পারবো। যখন আমাদের পছন্দের ওয়েবসাইটটি লোড নেবে না, যখন PUBG-তে লগইন করার চেষ্টা করলেও লগইন হবেনা অথবা ফেসবুকে বন্ধুবান্ধবদের মেসেজ করলেও সেটা আর ডেলিভার হবে না, তখন আপনার আমার মতো অধিকাংশ ইন্টারনেট অ্যাডিক্টরাই ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়বে।
ইন্টারনেটের অভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ইউজাররা একে অন্যকে ফোন কল করা শুরু করবে মেসেঞ্জারে টেক্সট করতে না পেরে। আর ফোন কল করেই তাদের প্রত্যেকের প্রথম কথা “হ্যালো” বা “কেমন আছো” হবে না, ফোন রিসিভ করার পরে তাদের সবার প্রথম কথাটি হবে “তোমারও কি ইন্টারনেট চলছে না?”। তখন হয়তো আপনার ফ্রেন্ডের নতুন প্রোফাইল পিকচারটি আপনার ভালো লাগলে আপনি সেটায় “লাভ” রিয়্যাক্ট দিতে না পেরে তাকে কল করেই জানাবেন যে তার নতুন প্রোফাইল পিকচারটি আপনার ভালো লেগেছে। ওয়েট, ইন্টারনেট না থাকলে তো কেউ ফেসবুক ব্যাবহারও করতে পারবে না, প্রোফাইল পিকচার আপলোড করা তো দুরের কথা!
তবে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে যখন মানুষ সবাইকে ফোন করা করা শুরু করবে, তখন টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেমের ওপরে অবিশ্বাস্যরকম চাপ পড়বে এবং এর ফলে ব্যাড কানেকশন, দুর্বল নেটওয়ার্ক, কল ড্রপ এগুলো হয়ে যাবে খুবই সাধারন। কারন মোবাইল অপারেটররা একদিনের মধ্যে তাদের নেটওয়ার্ক এতটা পাওয়ারফুল করতে পারবে না বা আপগ্রেড করতে পারবে না। একদিনের মধ্যে এত বেশি নেটওয়ার্ক প্রেসার সহ্য করতে না পেরে মোবাইল ফোন টাওয়ারগুলোও টেম্পোরারিলি কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে বা হ্যাং হয়ে যেতে পারে। মোবাইল অপারেটররা এই এক্সট্রা নেটওয়ার্ক প্রেসার সহ্য করার জন্য যতদিন না পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক আপগ্রেড করছে, ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যা চলতেই থাকবে। আর যদি না পারে, তাহলে অবশেষে আমাদেরকে সেই পুরনো দিনের মতো চিঠি লেখার অভ্যাস করতে হবে।
আর ওয়্যারলেস ফাইল ট্রান্সফারের কথা তো বাদই দিন, কারন ওয়াইফাই যেহেতু থাকবে না, তাই ফাইল বা ফটো যেকোনো কিছু ট্রান্সফার করার জন্যই দরকার হবে তারযুক্ত কানেকশন। অনলাইন মিডিয়া স্ট্রিমিং যেহেতু থাকবে না, তাই আমাদেরকে মুভি দেখার জন্য বা যেকোনো ফটো বা ভিডিও কন্টেন্ট দেখার জন্য ব্যাবহার করতে হবে ডিভিডি ড্রাইভ এবং ডিস্ক। তখন পিসিতে ডিভিডি ড্রাইভ আর অপ্রয়োজনীয় কোন অংশ হবে না।
এবার দেখা যাক অর্থনীতির ব্যাপারটি। বর্তমানে সকল ব্যাংকস এবং ফিন্যান্সিয়াল অরগানাইজেশন সব কাস্টোমারদের ফিন্যান্সিয়াল ডাটা বা অ্যাকাউন্ট ডাটা স্টোর করে রাখে তাদের অনলাইন সার্ভারে। তাই ইন্টারনেট না থাকলে এসব ডাটা স্টোর করা এবং অ্যাক্সেস করা বা প্রোসেস করা হয়ে পড়বে একেবারেই অসম্ভব। ইন্টারনেট মানি ট্রান্সফারও আর সম্ভব হবেনা। আপনার ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড হয়ে পড়বে জাস্ট একটি ইউজলেস প্লাস্টিকের কার্ড। বন্ধ হয়ে যাবে সব ধরনের ডিজিটাল মানি ট্রান্সফার সার্ভিস যেমন bKash, Paypal, Bank Transfer সবকিছু।
ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা টাকা-পয়সা দেরি করে হলেও ফেরত পাওয়ার আশা আপনি রাখতে পারেন। তবে আপনি যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন স্টোর করে রেখে থাকেন আপনার অনলাইন ওয়ালেটে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেগুলো আপনি আর কখনোই ফেরত পাবেন না বা অ্যাক্সেস করতে পারবেন না যতদিন না পর্যন্ত ইন্টারনেট আবার চালু হচ্ছে। তবে আপনার ব্যাংকে রাখা টাকা পয়সা ফেরত পেতে হলেও আপনাকে খুব ঝামেলা পোহাতে হবে।
যেহেতু ব্যাংক আপনার সম্পর্কে কোন ডেটা যেমন আপনার অ্যাকাউন্টে কত টাকা ছিলো, আপনি কত টাকা ডিপোজিট করেছেন, কত টাকা উইথড্র করেছেন, সেগুলো আর অ্যাক্সেস করতে পারবে না, তাই আপনার অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ট্র্যাক করা আপনার এবং তাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে কাউকে টাকা পাঠানোর একমাত্র ওয়ে হবে ফিজিক্যালি তার হাতে টাকা দেওয়া বা সেই পুরনো দিনের মতো পোস্ট অফিসে মানি অর্ডার করা। সর্বোপরি ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবীর সম্পূর্ণ ইকোনমির অনেক বড় পরিবর্তন ঘটবে।
এছাড়াও, পৃথিবীর সবথেকে বড় ইন্টারনেট বেজড বিলিয়নিয়ার ইন্ডাসট্রিগুলো যেমন গুগল,ফেসবুক, অ্যামাজন ইত্যাদি কোম্পানিগুলোর বিজনেস একেবারেই শেষ হয়ে যাবে এবং তারা আর কোনরকম অর্থ আয় করতে পারবে না। তাছাড়া এসব কোম্পানিতে কাজ করা এমপ্লয়ি এবং স্টাফরাও তাদের চাকরি হারাবে মুহূর্তের মধ্যেই। তাছাড়া যেসব অনলাইন বেজড কোম্পানি এবং পাবলিকেশন বা ব্লগ যারা অনলাইন অ্যাডভারটাইজমেন্টের ওপরে নির্ভর করে তাদের সম্পূর্ণ বিজনেস রানিং রাখে (যেমন- WireBD ব্লগ!) তারাও অ্যাফেক্টেড হবে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে। কারন, তাদের ইনকাম হয়ে দাঁড়াবে একেবারে শুন্য।
এছাড়া ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমেরও ক্ষতি হবে। এয়ারপোর্ট, রেইল স্টেশন ইত্যাদির মধ্যে একে অপরের সাথে কানেকশন থাকবে না যদি না ইন্টারনেট থাকে। এর ফলে ফ্লাইট ট্র্যাক করা এবং ট্রেইন ট্র্যাক করাও হয়ে পড়বে আরো কঠিন। এছাড়া এক দেশ থেকে আরেক দেশে কোন প্রোডাক্ট সেন্ড করার পরে অনলাইনে সেটি ট্র্যাক করাও সম্ভব হবেনা। এর ফলে ইন্টারন্যাশনাল শিপিং কোম্পানি এবং সর্বোপরি ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
তবে, ইন্টারনেট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব? এর ছোট উত্তর হচ্ছে, না। ইন্টারনেট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়, বা সম্ভব হলেও সেটা যথেষ্ট ঝামেলার কাজ। এতই ঝামেলার কাজ যে, ভুল করে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কেউ ইন্টারনেট ইচ্ছা করে বন্ধ করে দিচ্ছে, এটা হওয়া সম্ভব না। কারন, ইন্টারনেট হচ্ছে সারা পৃথিবীর কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলোর সমন্বয়ে তৈরি একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক, যার মালিকানায় কেউ নেই। ইন্টারনেটের কোন মালিক নেই যে ইন্টারনেটকে বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
তবে কয়েকটি দেশের সরকারের কাছে ইন্টারনেটের কিল সুইচ আছে যার সাহায্যে সেই দেশের সরকার শুধুমাত্র ওই দেশের ইন্টারনেট অফ করে দিতে পারে। তবে সারা পৃথিবীর ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই। ইন্টারনেটের কোন মেইন ম্যাশিন নেই। ইন্টারনেটের একটি পার্টকে বন্ধ করে দিলেও আরো হাজার হাজার অংশ আছে যেগুলো ফাংশনাল থাকবে।
তাই চিন্তা করবেন না, ইন্টারনেট কখনোই পারমানেন্টলি বন্ধ হয়ে যাবে না। আপনি আপনার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে পারবেন এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, অনলাইনে Memes দেখতে পারবেন এবং PUBG খেলতে পারবেন!
Image Credit: Shutterstock