আপনার কি সেই সময়টার কথা মনে আছে, যখন আমরা নোকিয়ার ফিচার ফোনে স্নেক গেমসটি খেলে স্নেকটিকে কয়েক মিটার বড় করে ফেলার পরে লেজে কামড় খাইয়ে গেম ওভার করিয়ে দিতাম এবং রাগে ফোনটি ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছা হত? কিংবা যেসময় আমাদের মুভি দেখার একমাত্র উপায় ছিলো ভিসিআর বা ডিভিডি প্লেয়ার? এসব জিনিস এখন আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
কারন মানুষ এবং মানুষের তৈরি প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত এত র্যাপিডলি উন্নত হচ্ছে যে, প্রত্যেকটি নতুন ডিভাইস এবং নতুন প্রযুক্তিও কয়েক বছরের মধ্যেই পুরনো হয়ে যায় এবং একসময় একেবারে হারিয়ে যায়। যাইহোক, আজকে আলোচনা করতে চলেছি এমন কয়েকটি জিনিস নিয়ে যেগুলো এখন আমরা সবাই প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করি, তবে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বা ২০ বছর পরে সেগুলো আর কোথাও খুঁজেই পাওয়া যাবে না!
এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু সমূহ
রিমোট কনট্রোল
রিমোট কনট্রোল জিনিসটি এখনকার দুনিয়ায় সবথেকে ইউজফুল প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। টিভি, এসি, গাড়ি ছাড়াও এখন আরও অনেক ডিভাইসের জন্য ডেডিকেটেড রিমোট কনট্রোল ডিভাইস পাওয়া যায়, যেগুলো ছাড়া সেই ডিভাইসটি ভালোভাবে কনট্রোল করা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি নিশ্চই জানবেন যে টিভি দেখার সময় সোফার কুশনের নিচে টিভির রিমোট হারিয়ে যাওয়া কতোটা ফ্রাস্ট্রেটিং একটি ব্যাপার। তবে এখনই রিমোট কনট্রোল ব্যাবহারের পরিমান আগের তুলনায় কিছুটা কমে গিয়েছে। বর্তমানে অনেক স্মার্টফোনের IR সেন্সর দেওয়া থাকে যার সাহায্যে স্মার্টফোনের মাধ্যমেই প্রায় সবধরনের রিমোট কনট্রোল ডিভাইস কনট্রোল করা যায়।
এছাড়া এখন বিভিন্ন ইলেকট্রিক ডিভাইসের জন্য ম্যানুফ্যাকচারাররা ডেডিকেটেড স্মার্টফোন অ্যাপস ডেভেলপ করছে যাতে সেই অ্যাপটির সাহায্যে স্মার্টফোন থেকেই ডিভাইসটি কনট্রোল করা সম্ভব হয়। এই কারনেই রিমোট কনট্রোলের ব্যাবহার আগের থেকে কমে গেছে। এছাড়া এখন সরাসরি স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভয়েস ডিকটেশন দিয়েই অনেক স্মার্ট ডিভাইস কনট্রোল করা সম্ভব হয়। আগামী কয়েক বছরে এই ধরনের আরও অনেক নতুন নতুন সেন্সর এবং নতুন টেকনোলজি আসবে যেগুলো ডেডিকেটেড রিমোট কনট্রোলকে সম্পূর্ণভাবে রিপ্লেস করে ফেলবে। ২০ বছরও নয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই রিমোট কনট্রোল হারিয়ে যেতে শুরু করবে।
ক্যাশ এবং ক্রেডিট কার্ড
এখন থেকে হয়তো ১০ বছর আগে যখন ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড ছিলো না, তখন কোথাও পেমেন্ট করার বা টাকা দেওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো ক্যাশ অথবা ব্যাংক চেক। এরপর যখন ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ড চালু হল, তখন এটা ছিলো পেমেন্ট সিস্টেমের দিক থেকে একটি যুগান্তকারী উন্নয়ন। ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে অনলাইন পেমেন্ট করার সুবিধা চালু হওয়ার পরে এটাই হয়ে দাঁড়ায় পেমেন্ট করার সবথেকে কনভেনিয়েন্ট এবং হ্যাসেল-ফ্রি ওয়ে। ক্রেডিট কার্ড এখনো পর্যন্ত অন্যতম জনপ্রিয় একটি পেমেন্ট মেথড। তবে এরপরে মোবাইল ওয়ালেটের সুবিধা যেমন- Paypal, Skrill কিংবা বাংলাদেশের bKash এর মতো পেমেন্ট সিস্টেমগুলো চালু হওয়ার পরে সেগুলো হয়ে দাঁড়ায় ক্যাশ এবং ক্রেডিট কার্ডের তুলনায় আরও সহজলভ্য এবং আরও বেশি কনভেনিয়েন্ট।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা ধারনা করেন যে ভবিষ্যতে এসব মোবাইল ওয়ালেট বা যার সাহায্যে স্মার্টফোন ব্যাবহার করেই সহজে পেমেন্ট করা যায়, এগুলোই হবে সবথেকে জনপ্রিয় এবং সবথেকে বেশি ব্যাবহার করা পেমেন্ট মেথড। আগামী কয়েক বছরে এসব মোবাইল ওয়ালেটের সুবিধা এবং ফিচারস আরও বাড়বে এবং অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, আগামী ২০ বছরের মধ্যেই ক্যাশ এবং ক্রেডিট কার্ডকে সম্পূর্ণভাবে রিপ্লেস করে ফেলার ক্ষমতা রাখতে এসব মোবাইল ওয়ালেটগুলো। তাছাড়া ভবিষ্যতে ফেসিয়াল রিকগনিশন ব্যাবহার করে পেমেন্ট করার সুবিধাও চলে আসবে। MasterCard ইতোমধ্যেই এমন একটি নতুন টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছে যার নাম Selfie Pay এবং এর সাহায্যে ফেসিয়াল রিকগনিশন ব্যাবহার করা পেমেন্ট প্রোসেস করা হবে।
চাবি (Key)
আগামী ২০ বছরের মধ্যে হয়তো আপনার ছেলে-মেয়েরা বা তাদের ছেলেমেয়েরা আপনার পুরনো ড্রয়ার ঘেটে স্টিলের তৈরি অদ্ভুত ডিজাইনের ছোট একটি পাত পেয়ে আপনাকে সেটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে যে এটি কি? তখন আপনি তাদেরকে বলবেন সেই সময়টার কথা যখন চাবি ব্যাবহার করে আমরা আমাদের মূল্যবান জিনিসের ড্রয়ার, আমাদের ঘরের দরজা, আমাদের গাড়ি ইত্যাদি সুরক্ষিত রাখতাম, আর এই চাবি একবার হারিয়ে কতটা হতাশার মধ্যে পড়তে হত আমাদেরকে। কিন্তু আপনার ছেলে-মেয়েদেরকে অথবা খুব বেশি হলে তাদের সন্তানদেরকে এই ঝামেলার মধ্যে কখনোই পড়তে হবে না। কারন, তখন চাবিকে সিকিউরিটি কি হিসেবে ব্যাবহার করার আর প্রয়োজনই পড়বে না।
তখন চাবি জিনিসটি এতই পুরনো হয়ে যাবে যে, সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষন করার মতো অবস্থা হবে। তখন চাবির জায়গা রিপ্লেস করবে আরও উন্নত সিকিউরিটি সিস্টেম যেমন, থ্রিডি ফেস রিকগনিশন, ভয়েস রিকগনিশন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিকিউরিটি, আইরিশ স্ক্যানিং ইত্যাদি। তখন হয়তো আপনার ঘরের দরজার লক খুলতে হলে আপনার চোখ স্ক্যান করতে হবে অথবা আপনার ফেসের থ্রিডি স্ক্যানিং করাতে হতে পারে। এছাড়া ভবিষ্যতে আরও বেশি রিলায়েবল সিকিউরিটি সিস্টেম আসতে পারে, তবে সেগুলো অবশ্যই মেটালের তৈরি চাবির মতো আউটডেটেড কিছু হবে না।
ওয়্যার
হেডফোনের তার জড়িয়ে যাওয়ার পরে সেটা ঠিক করা পৃথিবীর সবথেকে বিরক্তিকর কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে আমাদের ডিজিটার ডিভাইসগুলোতে তারের বা ওয়্যারের প্রয়োজনীয়তা একেবারে উঠে যায়নি। হেডফোনের কথা বললে এখন মানুষ তারযুক্ত হেডফোনের তুলনায় ওয়্যারলেস ব্লুটুথ হেডফোনই বেশি ব্যাবহার করে থাকে, তবে অন্যান্য ডিভাইস এখনো সেভাবে তারবিহীন হয়ে ওঠেনি। এখনকার অনেক ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনই ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্টেড। তবে মানুষ এখনো ওয়্যারড চার্জারি প্রিফার করে ফাস্ট চারজিং এর জন্য। ওয়্যারলেস মাউস এবং কিবোর্ড অনেক আগে থেকে মার্কেটে এভেইলেবল হলেও সাধারন পিসি ইউজাররা এবং গেমাররা সবসময়ই তারযুক্ত ডিভাইস প্রিফার করেন।
তবে সবসময় এমনটা থাকবে না। আগামী কয়েক বছরে তারবিহীন ডিভাইসের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বাড়বে যেমনটা বেড়েছে হেডফোনের ক্ষেত্রে। মানুষ ওয়্যারলেস টেকনোলজির দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়বে, যখন ওয়্যারলেস টেকনোলজি অ্যাকচুয়ালি আগের থেকে বেটার এবং মানুষের জন্য সহজলভ্য হবে। ২০ বছর নয়, আশা করা যায় আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যেই প্রায় মানুষই ওয়্যারলেস ডিভাইসগুলোর প্রতি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়বে এবং তারযুক্ত ডিভাইসের সংখ্যা প্রতিনিয়তই কমতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে এসে একেবারেই শুন্য হয়ে যাবে।
সিরিঞ্জ
যারা ইনজেকশন বা সিরিঞ্জ পুশ করতে ভয় পান, তাদের জন্য এটা সবথেকে ভালো খবর হতে পারে। আপনি হয়তো জানেন না যে, হেলথকেয়ার টেকনোলজি একটি নতুন ধরনের সিরিঞ্জ আবিষ্কার করেছে যেটাতে কোন নিডল নেই। এই ইনজেকশনটির নাম “জেট ইনজেকশন”। যেহেতু নিডল নেই, তাই এই সিরিঞ্জটি ইনজেক্ট করার সময় রোগীকে ব্যাথা পেতে হবে না। এই জেট ইনজেকশন আপনার ত্বকের ওপরে প্লেস করা হয় এবং এটি আপনার শরীরে ক্ষুদ্র ফ্লুইড স্ট্রিমের সাহায্যে মেডিসিন ইনজেক্ট করে। এছাড়া রোগীরা সবসময় ইনজেকশনের তুলনায় ওরাল মেডিসিন প্রিফার করে থাকেন।
তাই MIT এর রিসার্চাররা নতুন ধরনের ক্যাপসুল তৈরি করছেন যেটি ইনজেকশনের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে কাজ করবে। এই ক্যাপসুলটি অন্যান্য ক্যাপসুলের মতোই খেতে হবে এবং এই ক্যাপসুলটির ভেতরে থাকবে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিরিঞ্জ যেগুলো আপনার শরীরে মেডিসিন ইনজেক্ট করবে ক্যাপসুলটি আপনার পাকস্থলীতে পৌঁছানোর পরে। এই প্রোসেসটি শুনতে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও ডাক্তাররা নিশ্চিত করেছেন যে এটি যথেষ্ট সেফ একটি প্রোসেস হতে চলেছে।
লং ডেলিভারি সার্ভিস
আগামী বছরগুলোতে প্রোডাক্ট ডেলিভারি সার্ভিস অনেক বেশি ফাস্ট এবং অনেক বেশি রিলায়েবল হবে। এখন আমরা অনলাইন থেকে কোন প্রোডাক্ট কিনলে সেটি বাসায় ডেলিভারি নিতে অ্যামেরিকান কান্ট্রিগুলোতে কমপক্ষে ১ দিন থেকে শুরু করে আমাদের দেশে ৪-৫ দিন পর্যন্তও সময় লেগে যায়। কারন, সবধরনের প্যাকেজ ডেলিভার করা হয় ট্রেডিশনাল শিপিং মেথড যেমন ট্রাক কিংবা গাড়ী এগুলোর সাহায্যে। তবে এমন লং শিপিং টাইমের দিন আর থাকবে না, যখন ড্রোনের সাহায্যে প্রোডাক্ট ডেলিভারি করার ব্যাবস্থা করবে শিপিং কোম্পানিরা।
অ্যামেরিকার কয়েকটি স্টেটে অ্যামাজন ইতোমধ্যেই পরীক্ষামুলকভাবে ড্রোন ডেলিভারির সুবিধা চালু করেছে যার সাহায্যে একটি প্রোডাক্ট ড্রোনের সাহায্যে আকাশপথে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ডেলিভারি করা যায়। আগামী বছরগুলোতে আরও অনেক ই-কমার্স ইন্ডাসট্রি এবং ডেলিভারি কোম্পানিরাও ড্রোনের সাহায্যে প্রোডাক্ট ডেলিভারির ব্যাবস্থা করবে। আশা করা যায়, সর্বোচ্চ আর ১৫-২০ বছরের মধ্যেই প্রোডাক্ট ডেলিভারি করার প্রাইমারি মেথড হয়ে যাবে ড্রোন, কিংবা ড্রোনের থেকেও আরও বেশি কনভেনিয়েন্ট এবং দ্রুততর কোন মেথড।
সিগনেচার
এখন আমাদেরকে কোন ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্ট সাইন করতে হলে আমাদেরকে একমাত্র বলপয়েন্ট কলম এবং নিজের নাম ব্যাবহার করতে হয়। কিন্তু র্যাপিডলি ডেভেলপিং টেকনোলজির সাথে সাথে এই সাইনিং মেথডটিও হয়ে পড়ছে ব্যাকডেটেড। এখন থেকে ২০ বছর পরের কথা যদি চিন্তা করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তখন আমাদের ডকুমেন্টেশন ভেরিফাই করার জন্য আমাদেরকে আর নিজেদের হাতে লেখা সাইনের ওপরে ডিপেন্ডেন্ট হতে হবে না। কারন, হাতে লেখা সিগনেচার খুব সহজেই কপি করা বা জাল করা সম্ভব।
ভবিষ্যতে যখনই আমাদের সিগনেচার করার দরকার পড়বে বা নিজের আইডেন্টিটি ভেরিফাই করার দরকার পড়বে, আমাদেরকে কলম হাতে নেওয়ার দরকার পড়বে না। আমরা আমাদের আইডেন্টি ভেরিফাই করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল মেথড ব্যাবহার করতে পারবো। হতে পারে সেটি ফেস রিকগনিশন কিংবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিকগনিশন কিংবা আইরিশ স্ক্যানিং আবার হতে পারে ডিএনএ স্ক্যানিং এর মতো ওভারকিলড কোন টেকনোলজি। তবে এই ধরনের কোন অ্যাডভান্স টেকনোলজি যে আমরা ব্যাবহার করবো সিগনেচারের পরিবর্তে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
শুধু এগুলোই নয়, এমন আরও অনেককিছুই আছে যেগুলো ২০ বছর না, বরং আর ৫-৭ বছর পরেই হারিয়ে যাবে আর তার জায়গাটি রিপ্লেস করবে আরও উন্নত প্রযুক্তির নতুন কোন ডিভাইস। আপনার কি মনে হয়? আর এমন কি কি জিনিস আছে যেগুলো কয়েক বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে? নিচে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন!
Image Credit: Shutterstock